শেখ গফ্ফার রহমান, স্টাফ রিপোর্টারঃ
আমাদের বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর ও ভারতমহাসাগরের উপকূলের দেশ হওয়ার কারনে ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের ও গবাদিপশুর প্রাণহানি একেরারে কম নয়৷ প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়৷ তবে, গত কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে৷ তবে প্রকৃতির ক্ষিপ্ততাকে বাগে আনার সাধ্য মানুষের কোথায়?
আগে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হত না৷ ২০০০ সাল থেকে ঝড়ের নামকরণের জন্য নিয়ম বানানো হয়৷ তাতে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া শুরু করে৷ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড৷ সব দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নাম চাওয়া হয়৷ তার থেকে দেশ প্রতি ৮টি করে নাম বাছাই করে মোট ৬৪টি ঝড়ের নামকরণ করা হয়৷
“বাংলাদেশে কাছাকাছি সময়ে আঘাত হানা সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’৷ ২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত হানা ওই ঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।”
👉স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী যত ঘূর্ণিঝড়ঃ
♦১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ (বরিশাল), ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়৷ ঝড়ের প্রভাবে ৫ থেকে ৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়৷ এতে প্রাণ হারান প্রায় ১০ হাজার মানুষ৷
♦ঠিক পরের বছরই ১৯৬১ সালের ৯ মে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে৷ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার৷ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে ওই ঘুর্ণীঝড়ে৷
♦১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়৷
১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন মানুষের৷
♦১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন মানুষেরা৷ সেই বছরই ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জন মানুষের৷
♦পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ (বরিশাল) , খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়৷ এতে প্রাণহানি ঘটে ৮৫০ জনের৷
♦১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘দি গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’৷ এই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার৷ ওই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এই ঝড়ে প্রাণ হারান প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষরা৷ চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
👉স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় গুলোঃ
♦১৯৮৮ এর ঘূর্ণিঝড়ঃ
১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়৷ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার৷ এই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন মানুষ প্রাণ হারান৷
♦১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ঃ
ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার৷ এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়েছিল৷ ঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়৷ ২৯-৩০ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় “শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়” হিসেবে৷ এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষেরর প্রাণ গিয়েছিল বলে জানা যায়৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এক কোটির বেশি মানুষরা৷
♦১৯৯৭ এর ঘূর্ণিঝড়ঃ
১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশেপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে৷ ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বাতাসের বেগের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকায় প্লাবিত হয়৷ এরপর আরো কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল৷ তবে সেগুলো বাতাসের গতিবেগ ছিল বেশ কম৷
♦ঘূর্ণিঝড় সিডরঃ
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল৷ যদিও রেডক্রিসেন্টের হিসাব মতে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার৷ উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার৷ সিডর খুলনা ও বরিশাল এলাকায় তাণ্ডব চালায়৷ সমুদ্র থেকে উঠে আসা ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সব কিছু ভেসে যায়। সারা দেশে ৩২ জেলার ৩০লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দক্ষিনাঞ্চলের কৃষিজমি ও সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী সহ বনাঞ্চলও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
♦ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুঃ
রোয়ানু একটি ছোট ঘূর্নিঝড়, ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতের আংশিক অঞ্চলে আঘাত হানে৷ ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির৷ রোয়ানু-র আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের প্রাণহানি হয়৷
♦ঘূর্ণিঝড় মোরাঃ
২০১৭ সালের ৩০ মে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরা ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে৷ ঝড়ের তাণ্ডবে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়৷ কক্সবাজারে বিদ্যুৎব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ জমির ফসল এবং লবন চাষীদের জমাকৃত লবন নষ্ট হয়ে যায়৷ দুজন নারীসহ তিনজন মারা যায়৷
♦ঘূর্ণিঝড় ফণীঃ
২০১৯ সালের ৩ মে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে নয় জনের মৃত্যু হয়৷ তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল অনেক বেশি৷ সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়৷
♦ঘূর্ণিঝড় বুলবুলঃ
২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বার বার দিক বদল করে অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়৷ ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন৷ ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা৷ ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবন৷
♦সুপার সাইক্লোন আম্পানঃ
২০২০ সালের ১৬ মে থেকে ২১ মে বিলুপ্তি হয় এই সুপার সাইক্লোনের। বাংলাদেশ ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে প্রাথমিকভাবে প্রায় সাড়ে এগারোশ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছিল সরকার। বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্টসহ অবকাঠামোর পাশাপাশি ঘরবাড়ি, কৃষি এবং চিংড়ি ঘেরসহ মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
দক্ষিণ পশ্চিমের জেলায় পানের বরজ থেকে শুরু করে রাজশাহীতে মৌসুমী ফল আম এবং উত্তরের অন্য জেলাগুলোয় ধান এবং সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিলো।
♦অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াসঃ
২০২১ সালের মে মাসের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ছিল। এটি ২০২১ সালের উত্তর ভারত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড় মৌসুম তৃতীয় নিম্নচাপ, দ্বিতীয় গভীর নিম্নচাপ, দ্বিতীয় ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় এবং দ্বিতীয় অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছিল। এঝড়ে ৯ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল।
♦প্রবল ঘূর্ণিঝড় অশনিঃ
বঙ্গোপসাগরে বর্তমানে সক্রিয় একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। অশনি ২০২২ সালের উত্তর ভারত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের তৃতীয় নিম্নচাপ ও গভীর নিম্নচাপ এবং প্রথম ঘূর্ণিঝড়। এটি একটি নিম্নচাপ থেকে তৈরি হয়েছিল যেটিকে ৭ মে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিল। শক্তিশালীকরণের জন্য পরিবেশগত অবস্থা অনুকূল ছিল, যেহেতু পরের দিন ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধির আগের দিন ঘূর্ণনটি একটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছিল, যাকে অশনি নামকরণ করা হয়।