জয়নাল হাজারীর জন্য শোকগাথা-আশরাফুল আলম খোকন………..
আপনারা অনেক ক্ষমতাবান, দিনকে রাত করতে পারেন। আপনারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, মানুষ আপনাদের কথা বিশ্বাস করে। আপনাদের অনেক সম্পদ, তা দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আপনাদের দ্বারা হয়তো অনেক কিছুই সম্ভব। কিন্তু মানুষের নিখাদ ভালোবাসা – তা হয়তো আপনাদের ডিকশনারির বাইরে। তা পেতে হলে অন্যকিছু থাকতে হয়।
আপনারা বাহবা পাবেন, হাততালি পাবেন, লোকজনের মোসাহেবি পাবেন। কিন্তু যেদিন থাকবেন না, সেদিন থেকেই বিস্মৃত হতে থাকবেন। কারণ ক্ষমতা দিয়ে, দম্ভ দিয়ে অনেক অপপ্রচার করেছেন। অনেককে অপরাধী বানিয়েছেন। অনেক মানুষের কাছে অনেকের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী। কিন্তু তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা কি কমেছে ? তাঁর নিথর দেহ ঘিরে নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বণিতার অঝোরে কান্নার আওয়াজও নিশ্চয়ই আপনাদের কর্ণ কুহুরে প্রবেশ করেছে। তাঁর কোনো সন্তানও নেই বিয়েও করেননি।
জয়নাল হাজারীর কর্মজীবন আমি বিশ্লেষণই করবো না। দেশের মানুষের কাছে তার ভাবমূর্তি নেতিবাচক- এটাই সত্য। যারা তার এই ভাবমূর্তি তৈরী করেছেন তারাও ভিন্নরকমের প্রভাবশালী। তারাও কোনোদিন মারা যাবেন। তাদেরও জানাজা হবে। সেদিন তাদের জানাজায় আসা মানুষ গুনবো, যদি বেঁচে থাকি। কেন গুনবো জানেন ? তাদের প্রতি মানুষের ভালোবাসার পরিমাপ করতে। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজারীর জানাজার ছবি ও তাদের জানাজার ছবি পাশাপাশি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করবো।
একজন নিঃস্ব মানুষ তার এলাকার মানুষজনের কাছে কতটা ভালোবাসার, তা প্রমাণিত হয়েছে তার জানাজায়। শেষ জীবনে তিনি নিঃস্বই ছিলেন। ভালোবাসার মানুষগুলো শুধু নশ্বর দেহের সামনে হাজির হয়েছে। সেখানে কোনো ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি ছিলোনা। শুধু তাঁর কর্ম ছিলো …হ্যা, কর্মগুণের কারনেই জয়নাল হাজারীর জানাজায় লাখো মানুষ এসেছে, তাদের প্রিয়জনের জন্য ভালবাসার মিছিল হয়ে।
২০০১ সালে কিছু পত্রিকাতে পড়েছিলাম জয়নাল হাজারীর শৈলকুঠি বাড়িতে নাকি গুপ্তগুহা পথ আছে। গুপ্ত টর্চার সেল আছে। ওনার অনুপস্থিতেই একবার ওই দোতলা বাড়িটিতে গিয়েছিলাম ২০০৪ সালের দিকে। গুপ্ত গুহা পথ ও গুপ্ত টর্চার সেল অনেক খুঁজেছি পাইনি। তখন বুঝেছি এটাও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার।একসময়ের বাঘ জয়নাল হাজারীকে অপপ্রচার করে আপনারা বিড়াল বানিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদরাও তাঁর সাথে কথা বলতে বিব্রত হতেন। তাঁর হাতেই যারা তৈরী, যাদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন; তারাও তাকে এড়িয়ে চলতেন। এই যে তাঁর ভাবমূর্তির সঙ্কট; তা ইচ্ছে করে, পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা হয়েছে। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর খাঁটি সৈনিক ছিলেন, শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হাতিয়ার ছিলেন। এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নেত্রীর কথার বাইরে যাননি। এক সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছিলেন, নেত্রী বলেছেন বলেই তিনি চুপ হয়ে গেছেন। এখানেও তিনি ব্যতিক্রম এবং অনুগত।
যাকে এক নজর দেখার জন্য মানুষ ভীড় জমাতো, পত্রিকার পাতায় লীড নিউজ হতো; সেই হাজারী শেষ জীবনে রাস্তায় একা একা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটেছেন। কোন বডিগার্ড নিয়ে চলেননি। তিনি যদি এতোটাই খারাপ হতেন, তাহলে যে কেউ তখন প্রতিশোধ নিতে পারতো। একা দেখে কেউ তাকে গালি দিয়েছে এমন কথাও শুনিনি। আপনারা তাকে হেয় করার অপচেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর এলাকার সাধারণ মানুষের চোখে তিনি বাঘই রয়েছেন এবং ভালোবাসার মানুষ হয়েই থাকবেন।
তাঁর জানাজার লাখো মানুষের ভালোবাসার ছবি অনেক পত্রিকাতেই দেখিনি। তাতে কি হয়েছে – জয়নাল হাজারীরা ক্ষণজন্মা। বিশ্বকবির ভাষায়…
“মোর লাগি করিয়ো না শোক ,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক ।
ফিরিবার পথ নাহি;
দুর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায় ।
হে বন্ধু, বিদায় !!”
–আশরাফুল আলম খোকনের লেখা