শেখ গফ্ফার রহমান, একাত্তর নিউজ ডেক্সঃ
শীতকালে রোদের প্রখরতাও বায়ু দুষণে জানান দিচ্ছে যেন কয়লাখনিতে এসে গেছি।
যশোর থেকে আপনি যদি মহাসড়ক ধরে খুলনার পথে যান তবে প্রেমবাগ গেট পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই রাস্তা ও আশপাশের পুরো এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন দেখে অবাক হবেনই। আরও কিছুটা পথ যেতেই বাতাসে পোড়া গন্ধ পাবেন।
পরিবেশটা রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো।
অভয়নগরের বাসিন্দারা জানান, পাশে ভৈরব নদের তীরে কয়লা ডাম্পিং চলছে। সেখান থেকে উড়ে আসা কয়লার ধোঁয়া ও ধুলায় সৃষ্টি হয়েছে এ ‘কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ’।
এর সঙ্গে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বসতবাড়ি
ঘিরে কয়লা ডাম্পিং করায় অনেকে ঘরবাড়ি ছাড়তে
বাধ্য হচ্ছেন। নানা কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের মিছিলে যুক্ত হচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশের সার ও সিমেন্ট ব্যবসায় নদীবন্দর কেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক এলাকা যশোরের শিল্পশহর অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া বাজার। এখানে খাদ্যশস্য, রড, পাথর ও বালুর ব্যবসাও রমরমা। বহুমুখী যোগাযোগ সুবিধার কারণে কয়েক বছর ধরেএ বন্দরে প্রসার ঘটেছে কয়লা ব্যবসার। যশোর-খুলনা মহাসড়কের বসুন্দিয়া মোড় থেকে রাজঘাটের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
যেখানে পাশাপাশি রয়েছে নদী, সড়ক ও রেলপথ। তার মাঝে বসতবাড়ি ঘিরে থাকা কৃষিজমি ও বাগানে ডাম্প করে রাখা হয়েছে কয়লা।
কয়েকশ’ মিটার পর পর চোখে পড়ে খোলা আকাশের নিচে একেকটি কয়লার পাহাড়। আর এই কয়লার বিষাক্ত ধোঁয়া ও দুর্গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে পুরো এলাকা।
নওয়াপাড়া পৌরশহরের রাজঘাট ও পাঁচকবর, ভাঙাগেট এলাকায় কয়লার মজুদ সবচেয়ে বেশি। ভাঙাগেট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা বলেন এখানে ৬০-৭০ বছর ধরে তাদের তিন প্রজন্মের বসবাস। কয়লার প্রসঙ্গে ক্ষোভের সঙ্গে তাহারা বলেন, জ্বালানি কয়লার প্রভাবে আশে পাশের গাছগুলো শুকিয়ে মরে গেছে বেশ আগেই। এখন বাড়িঘরেও বসবাস দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ঘর-দরজা, আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছদ কয়লার ধুলায় সয়লাব। এমনকি খেতেও হচ্ছে কয়লার ধুলা মেশানো ভাত-তরকারি। তাহারা অভিযোগ করেন কয়লার ডিপো সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সময় স্মারকলিপি, মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা নেয়নি।
পাঁচকবরও ভাঙাগেট এলাকার বাসিন্দারা আরো জানান, কয়লার বিষাক্ত ধুলা ও ধোঁয়ায় তারদের পরিবারের সবাই ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। রোগের মাত্রা এতটাই যে, চিকিৎসা কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলছে না। বাধ্য হয়ে বাড়িতে নেবুলাইজার মেশিন কিনে নিয়েছেন। এখন ভিটে-মাটিতে থাকতে পারবেন কি-না, সেই আশঙ্কায় রয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, বসুন্দিয়া থেকে রাজঘাট
পর্যন্ত তালতলা, নওয়াপাড়া বাজারের আশপাশ, গুয়াখোলা, কলাতলা, পাঁচকবর, মশরহাটি, ভাঙাগেট,
মহাকাল, বালিয়াডাঙ্গা, চেঙ্গুটিয়া, চাপাতলা, দুর্গাপুর ও জগনাথপুর এলাকায় দেড় শতাধিক কয়লার ডিপো গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন কয়লা নওয়াপাড়ার বিভিন্ন ঘাটে জাহাজে করে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেসার্স উত্তরা ট্রেডার্স, মেসার্স নওয়াপাড়া ট্রেডার্স, মেসার্স শেখ ব্রাদার্স, মেসার্স মাহাবুব অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স জয়েন্ট ট্রেডিংসহ প্রায় ৫০টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই বিপুল পরিমাণ কয়লা নওয়াপাড়ায় আমদানি করে। কয়লা জাহাজ থেকে নামিয়ে নদীর পশ্চিম পাড় থেকে সড়ক ও রেলপথের পাশে ও আবাসিক এলাকায় খোলা আকাশের নিচে ডাম্প করে রাখা। এরপর পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ট্রাকে লোড করে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন স্থানে।
এমনিতে দুই দফায় লোড-আনলোড, তার ওপর খোলা আকাশের নিচে কয়লা ডাম্প করায় রেল লাইনের দুই পাশের মালিকনা বড় বড় গাছ মরে যাচ্ছে। পৌরশহরের আবাসিক এলাকা ও গ্রামের মধ্যে কয়লা রাখায় দিন-রাত সবসময়ই বাতাসে কয়লার ধুলা ও ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। এসব এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শিশু-বয়স্কসহ সব বয়সের মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কয়লাবোঝাই
কার্গো জাহাজ ও বার্জ (লাইটার জাহাজ) থেকে ফেলা বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে ভৈরবের পানি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কয়লার পোড়া দুর্গন্ধে নওয়াপাড়ার বাতাস বিষময় হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে কয়লার স্তূপে আগুন ধরে যায়। এ ছাড়া কয়লার ধুলা ঢুকছে মসজিদ-মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
নওয়াপাড়ার লোকজনের অভিযোগ, কয়লা আমদানী থেকে শুরু করে পাইকারী ও খুচরা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক নেতারাও। তারা ব্যাপক প্রভাবশালী ও দাপুটে। যে কারণে সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও পরিত্রাণ মিলছে না কোনোভাবেই। আবাসিক এলাকা থেকে কয়লার ইয়ার্ড সরানোর দাবি জানিয়েও কোনো
লাভ হচ্ছে না। বরং ক্ষমতার জোরে আবাসিক এলাকায় নিয়ম না মেনে দাপটের সঙ্গে কয়লার মজুদ ও বেচাকেনা চলছে।
নওয়াপাড়া নদীবন্দরে কাজ করেন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। কয়লার কারণে তারা ফুসফুসজনিত রোগে ।