http://www.71news24.com/2019/03/18/1128
একাত্তর নিউজ ডেস্ক : দিনটা যেন ক্রিকেট বিধাতা লিখে রেখেছিলেন তার নামেই! তাই বুঝি যখন যা করতে চাইলেন, সেটাই পারলেন সাকিব আল হাসান। ব্যাট হাতে গড়ে দিলেন দলের লড়াকু পুঁজির ভিত। বল হাতে তো ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকেই। সোমবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ ৬২ রানে জিতল বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারের মহানায়কোচিত পারফরম্যান্সে। যে জয়ে সেমিফাইনালের দৌড়ে বেশ ভালোভাবেই টিকে রইল টাইগাররা।
ব্যাট হাতে এই বিশ্বকাপের বড় বিজ্ঞাপন তিনি। রান সংগ্রাহকের তালিকায় নিজেকে নিয়ে গেছেন সবার ওপরে। সাউদাম্পটনের রোজ বোলে বাংলাদেশকে ২৬২ রানের চ্যালেঞ্জিং পুঁজি এনে দিতে এদিনও হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। বোলিংয়ে তার ভ‚মিকা নিয়ে যে কিঞ্চিৎ কানাঘুষা ছিল, এদিন সেটাও দমিয়ে দিলেন চিরতরে। এমনভাবেই দিলেন, ক্রিকেট বিশ্ব অবাক বিস্ময়েই দেখল তা। আফগানিস্তান দেখল একা হাতে তাদের গুঁড়িয়ে দিয়ে সাকিবের মহানায়ক হয়ে ওঠা।
দারুণ শুরুর পর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছিল কাবুলিওয়ালার দেশের ব্যাটসম্যানরা। সেই চাওয়া পূরণ হয়নি। উল্টো ম্যাচসেরা সাকিবের স্পিন বিষে নীল হতে হয়েছে। ২০০ রানে গুটিয়ে গেছে আফগানদের ইনিংস। ইংল্যান্ডের মাটিতেই শুধু নয়, বিশ^কাপে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ৫ উইকেট নিয়েছেন সাকিব, মাত্র ২৯ রান খরচায়। ২০৪ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে এটাই ‘বোলার’ সাকিবের সেরা। পেছনে পড়ে গেছে ২০১৫ সালে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪৭ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি।
সাকিবের কীর্তির শেষ এখানেই নয়। বিশ^কাপে হাজার রান আর ৩০ উইকেট নেওয়া একমাত্র অলরাউন্ডার এখন তিনি। ভারতের যুবরাজ সিংয়ের পর বিশ্বকাপে একই ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি আর ৫ উইকেট নেওয়া প্রথম ক্রিকেটার টাইগার অলরাউন্ডারই। এই বিশ^কাপ তিনি শুরু করেছিলেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ অলরাউন্ডার হিসেবে। দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে সেই পরিচয় ছাপিয়ে যাচ্ছিল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৭ রানে ২ উইকেট নিয়েছিলেন, সেটাই ছিল সেরা। সব মিলে ঝুলিতে জমা করেছিলেন ৫ উইকেট। ওইটুকুতে কি আর খুশি থাকার পাত্র তিনি? এদিন তো ‘বোলার’ সাকিব ছাড়িয়ে গেছেন ‘ব্যাটসম্যান’ সাকিবকেও।
গুলবাদিন নাইব আর রহমত শাহ উড়ন্ত সূচনাই দিয়েছিলেন আফগানিস্তানকে। শঙ্কা দানা বাঁধছিল বাংলাদেশ শিবিরে। ২৪ রান করা রহমতকে মিডঅফে তামিম ইকবালের ক্যাচ বানিয়ে ৪৯ রানের জুটি ভাঙেন সাকিব, উড়িয়ে দেন শঙ্কার মেঘ। প্রথম স্পেলে উইকেট ছিল ওই একটিই। পরের স্পেলে যখন ফিরলেন, ২ উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তান তখন ১০৪ রানে। মোসাদ্দেক হোসেনের শিকার হয়ে হাসমতউল্লাহ শাহিদি ফিরে যাওয়ার পর অধিনায়ক নাইবের ব্যাটে ফেরার লড়াইটা জমিয়েই তুলেছিল তারা। তিন বলের ব্যবধানে সাকিবের অসাধারণ দুই ডেলিভারিতে সেই লড়াইয়ের যবনিকাপাত।
৪৭ রান করা নাইবকে ড্রাইভ খেলতে প্রলুব্ধ করলেন ঝুলিয়ে দেওয়া এক ডেলিভারিতে, ফাঁদে পা দিলেন আফগান দলপতি। কাভারে লিটন দাস দারুণ এক ক্যাচ নিলেন। তাতেই ৩০ উইকেট পূর্তি। এরপর আরও সামনে এগিয়ে যাওয়া। ওভারের তৃতীয় বলে মোহাম্মদ নবীকে আউট করতে কারও সাহায্য নেননি, অসাধারণ এক আর্মারে বোল্ড করে দিয়েছেন। মাঝে এক ওভার বিরতি দিয়ে আসগর আফগানকে বানিয়েছেন সাব্বির রহমানের ক্যাচ।
২ উইকেটে ১০৪ থেকে চোখের পলকেই ৫ উইকেটে ১১৭ আফগানিস্তান। দলটি ৬ উইকেটে ১৩২ বনে যায় ইকরাম আলী খিলের রানআউটে। এরপর মাঠে নেমেই প্রতিঘাত হানার চেষ্টা নাজিবুল্লাহ জাদরানের। সামিউল্লাহ শেনওয়ারিও তাল মেলান। সপ্তম উইকেটে তাদের ৫৬ রানের জুটিটা নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছিল। অধিনায়ক মাশরাফি তখন আবারও সাকিবের শরণাপন্ন হলেন। নিরাশ করেননি তিনি। ২৩ রান করা নাজিবুল্লাহকে ফেলেন স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে।
এরপর ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ছিল সময়ের অপেক্ষা। একপ্রান্ত আগলে শেনওয়ারি (৪৯*) লড়াই চালিয়ে গেলেও অপেক্ষাটা ঘুচাতে খুব বেশি সময় নেননি মোস্তাফিজুর রহমান আর মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। রশিদ খান আর দৌলত জাদরানকে নিজের শিকার বানিয়েছেন ম্যাচে ৩২ রানে ২ উইকেট নেওয়া মোস্তাফিজ। এরপর মুজিব উর রহমানকে বোল্ড করে জয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন সাইফউদ্দিন। মুস্তাফিজ-সাইফউদ্দিনরা খানিকটা সাফল্য পেলেও রোজ বোলের উইকেট ছিল স্পিনবান্ধব। সাকিব-মোসাদ্দেক-মিরাজরা তা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আরও আগে, আফগান স্পিনার মুজিব আর নবী যখন চোখ রাঙাচ্ছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা টাইগাররা প্রথম উইকেট হারায় ২৩ রানে। সৌম্য সরকারের সঙ্গে জায়গা অদল-বদল করে ওপেনিংয়ে তামিম ইকবালের সঙ্গী হওয়া লিটন শুরুটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু ১৬ রান করে কাভারে ক্যাচ দেন হাসমতউল্লাহর হাতে। ক্যাচটা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে সৌম্যর এলবিডবিøউর সিদ্ধান্ত নিয়েও। দুই ক্ষেত্রেই তৃতীয় আম্পায়ার আলিম দারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন মাঠের আম্পায়ারদ্বয়। বিতর্কের অবকাশ রেখে দুটো সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের বিপক্ষে দিয়েছেন পাকিস্তানি আম্পায়ার আলিম।
ওই দুটো আউট নিয়ে টাইগার শিবিরে আক্ষেপ থাকলেও ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স নিয়ে তা একেবারেই নেই। ব্যাটিংটা হয়েছে পরিকল্পনা মেনে। তামিম (৩৬), সাকিব, মুশফিকরা খেলেছেন সময় আর দলের দাবি মিটিয়ে। বাউন্ডারি হাঁকানোয় মনোনিবেশ না করে সিঙ্গেলস আর ডাবলসে মনোযোগী হয়েছিলেন তারা। সাকিব ৫১ রান করেছেন ৬৯ বলে, হাঁকিয়েছেন মোটে একটি বাউন্ডারি। মুশফিক ৮৩ রান করে আউট হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ আর সাকিবের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে বিশ^কাপে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকানোর সুযোগ নষ্ট করে। তার ৮৭ বলের ইনিংসে ছিল ৪টি চার আর ১টি ছক্কা।
২৭ রান এসেছে মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে। শেষের দিকে ৪টি চারে ২৪ বলে ৩৫ রানের চমৎকার এক ক্যামিও উপহার দিয়েছেন মোসাদ্দেক। তাতেই বাংলাদেশ পেয়েছে চ্যালেঞ্জিং পুঁজি। ৩৯ রানে ৩ উইকেট নিয়েও বড় বাধা হতে পারেননি মুজিব। ৪৪ রানে ১ উইকেট নেওয়া নবীও নন। ১০ ওভারে ৫২ রান খরচ করা রশিদ খানকে তো উইকেটশূন্যই রাখল বাংলাদেশ। অতীত বলে, রশিদ উইকেটশূন্য থাকলে আফগানিস্তান জেতে না।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : ৫০ ওভারে ২৬২/৭ (লিটন ১৬, তামিম ৩৬, সাকিব ৫১, মুশফিক ৮৩, সৌম্য ৩, মাহমুদউল্লাহ ২৭, মোসাদ্দেক ৩৫, সাইফ ২*; মুজিব ৩/৩৯, দৌলত ১/৬৪, নবী ১/৪৪, গুলবাদিন ২/৫৬)।
আফগানিস্তান : ৪৭ ওভারে ২০০ (গুলবাদিন ৪৭, রহমত ২৪, হাসমতউল্লাহ ১১, আসগর ২০, শেনওয়ারি ৪৯*, ইকরাম ১১, নাজিবুল্লাহ ২৩; মোস্তাফিজ ২/৩২, সাইফউদ্দিন ১/৩৩, সাকিব ৫/২৯, মোসাদ্দেক ১/২৫)
ফল : বাংলাদেশ ৬২ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা : সাকিব আল হাসান
Please follow and like us: