ইসলামে মাতাপিতার মর্যাদা

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128

পৃথিবীতে পিতামাতার সম্মান ও মর্যাদা নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয়। মহান আলল্গাহতায়ালা সমগ্র বিশ্ববাসীর একমাত্র উপাস্য ও অভিভাবক। পিতামাতা হলেন শুধু তার সন্তানদের ইহকালীন জীবনের সাময়িক অভিভাবক। সুতরাং সন্তানদের কাজ হলো, মহান স্রষ্টা ও পালনকর্তা আলল্গাহতায়ালার যাবতীয় হুকুমের পাশাপাশি পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা ও তাদের মান্য করা। সন্তান জন্মের পর বাল্য, শৈশব বা কৈশোর পর্যন্ত পিতামাতার তত্ত্বাবধানে এবং সম্পূর্ণ অনুগত থাকে। অতঃপর যৌবনে ও সংসার জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিতামাতার সঙ্গে তার সন্তানদের মতভিন্নতা দেখা দিতে পারে, এটা স্বাভাবিক। সে জন্যই আলল্গাহতায়ালা পিতামাতার সঙ্গে তার সন্তানদের বাল্যজীবনের ভালোবাসার মতো সারাজীবন তা মজবুত ও বহাল রাখার আদেশ দিয়েছেন।

মহান আলল্গাহ বলেন, আমি মানুষকে তার পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ এবং প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়াতে লেগেছে ৩০ মাস (আহকস্ফাফ ১৫)। ওই আয়াতে আলল্গাহতায়ালা স্বীয় ইবাদতের সঙ্গে পিতামাতার সেবাকে একত্রভাবে বর্ণনা করেছেন। এর মাধ্যমে এটিকে তাওহিদ বিশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বুঝানো হয়েছে। এর কারণ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যেমন আলল্গাহর কোনো শরিক নেই, জন্মদাতা হিসেবে তেমনি পিতামাতারও কোনো শরিক নেই। আলল্গাহর ইবাদত যেমন বান্দার ওপর অপরিহার্য, পিতামাতার সেবাও তেমনি সন্তানের ওপর অপরিহার্য। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও (মনে রেখ, তোমার), প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই (লোকমান ১৪)। এখানেও আলল্গাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে সমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

অন্যত্র মহান আলল্গাহ এরশাদ করেন, ‘আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তাদের ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না আর শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বলো- হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো; যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল (বনি ইসরাইল ২৩-২৫)।

পবিত্র কোরআনের বাণীগুলোকে পরম শ্রদ্ধা ও বিনয়াবনত অন্তঃকরণে মূল্যায়ন করতে হবে। এখানে কোনো দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করা হতে বিরত থাকতে হবে। আয়াতগুলোতে সাধারণভাবে মানুষকে আলল্গাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি অবিচল থাকা ও সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, তাদের সেবাযত্ন ও আনুগত্যের নির্দেশও দান করা হয়েছে। অবশ্য আয়াতের প্রারম্ভেই পিতামাতা উভয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মাতার কষ্টের কথা উলেল্গখ করার তাৎপর্য এই যে, মাতার পরিশ্রম, কষ্ট অপরিহার্য ও জরুরি। গর্ভধারণের সময় কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট সর্বাবস্থায় ও সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাতাকেই সহ্য করতে হয়। পিতার জন্য লালন-পালনের কষ্ট সহ্য করা সর্বাবস্থায় জরুরি হয় না।

পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গায় আলোচ্য বিষয়ে উলেল্গখ রয়েছে। একইভাবে এখানেও আলল্গাহর তাওহিদের প্রতি দাওয়াতের সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের কথা উলেল্গখ করা হয়েছে। এটা পিতামাতার জন্য অসামান্য সম্মান ও মর্যাদা।

ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি নবীকে (সা.) জিজ্ঞেস করলাম, আলল্গাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন, সময়মতো নামাজ পড়া। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, পিতামাতার সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আলল্গাহর পথে জিহাদ করা (বোখারি ৪৯৬)। এই হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, আলল্গাহর তিনটি অতি প্রিয় কাজের মধ্যে একটি হলো বাবা-মার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। মহান আলল্গাহ এরশাদ করেন, ‘আলল্গাহ তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার করো’ (নাহল ৭৪)। কোরআনুল কারিমে পিতামাতার হকগুলোকে আলল্গাহতায়ালার ইবাদত ও আনুগত্যের সঙ্গে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে বান্দা তার জীবদ্দশায় সার্বিক সতর্কতা বজায় রেখে অকৃত্রিমভাবে পিতামাতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। অবশ্য বান্দার কাছে আলল্গাহর হক ব্যাপক; কিন্তু সন্তানের কাছে পিতামাতার হক সীমাবদ্ধ। যেমন পিতা তার পুত্রকে শরিয়তবিরোধী কোনো কাজের আদেশ করলে, পুত্র তা প্রত্যাখ্যান করলেও কোনো দোষ হবে না। যেমন আলল্গাহতায়ালা স্বীয় কালামে বলেছেন- পিতামাতা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়কে শরিক করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই। তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে উত্তমভাবে সহাবস্থান করবে (লোকমান ১৫)।

মানবজাতিকে এক আলল্গাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর শ্রেষ্ঠত্বের এই মর্যাদা রক্ষায় তাকে প্রচুর জ্ঞান-বুদ্ধি দান করা হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির শত্রু ইবলিস ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে সন্তানকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে শয়তানের অনুগত কোনো মুশরিক পিতামাতা পিতৃত্বের দাবি নিয়ে নিজ সন্তানদের শিরক স্থাপনে বাধ্য করতে না পারে। কারণ শিরক হলো অমার্জনীয় পাপ। এখানে মহান আলল্গাহর পক্ষ থেকে অধিকারপ্রাপ্ত পিতামাতা ও সন্তান উভয়কেই শিরকমুক্ত থেকে ইসলামের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিগ্রহণের কঠোর নির্দেশ রয়েছে।

পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার আলল্গাহর তাওহিদের পরে সবচেয়ে বড় নেক কাজ। শরিয়ত তথা কোরআনের আয়াত ও রাসুলের হাদিস দ্বারা এর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের ব্যাপারে সালফে সালেহীনের কাহিনীর মধ্যেও অতি উত্তম উদাহরণ রয়েছে। ইসলামে মৃত্যুর আগে ও পরে সর্বাবস্থায় পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের জোর তাকিদ আজ প্রমাণিত।

 লেখক,প্রভাষক (আরবি বিভাগ), চাটখিল কামিল (এমএ) মাদ্রাসা, নোয়াখালী
ibrahim010187@gmail.com

Please follow and like us: