মুফতি আমিন ইকবাল
আগামী সোমবার সারা দেশে পালিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা মুসলিম জাতির অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। ঈদের দিন মুমিন-মুসলিমরা আনন্দ উদযাপন করে থাকেন। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে খুশি ভাগাভাগি করেন। উচ্ছাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে মেতে ওঠেন অনাবিল আনন্দে। প্রায় সাড়ে ১৪শ বছর পূর্ব থেকে এ উৎসব পালন করে আসছে বিশ্ব মুসলিম সমাজ। হাদিসে বর্ণিত রাসুল (সা.) হিজরত করে মদিনায় এসে দেখেন সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দুদিন উৎসব পালন করে। সেই উৎসব সম্পর্কে নবীজি (সা.) জানতে চাইলে তারা জানায়, ‘জাহেলি যুগ থেকে আমরা এ দুদিন উৎসব পালন করে আসছি।’ পরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুদিনের বদলে আরও উত্তম দুদিন দিয়েছেন উৎসবের জন্য। সে দুদিন হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।’ (আবু দাউদ : ১/১৬১)। সেদিনের পর থেকে মুসলিম জাতি বছরে দুটি ঈদ উৎসব পালন করে আসছে স্বমহিমায়, সগৌরবে।
ঈদ যেমন আনন্দের; তেমনি ইবাদতেরও। আর ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় ইবাদত আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করা। মুসলিম সামর্থ্যবান ব্যক্তির পক্ষে ঈদুল আজহার সময় পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর অসীম ত্যাগকে সমুন্নত করতে এ বিধান পালনের কথা জানিয়েছেন নবী মুহাম্মদ (সা.)। অবশ্য কোরবানি কেবল নবী মুহাম্মদের উম্মতের জন্য নয়; যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল এ বিধান। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। উদ্দেশ্য একটাই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)
কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ পরীক্ষা করেন বান্দা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তার রবের জন্য। একই সঙ্গে ঈদের সময় সামর্থ্যবান বান্দার সম্পদ থেকে পশু কোরবানি করিয়ে গরিবের ঘরেও আনন্দ বিলানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। তাই তো বিধান হয়েছেÑ কোরবানির গোশত মালিক একা খাবেন না পাড়া-প্রতিবেশী অসহায়-গরিবকেও দিতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কোরবানির গোশত তিনভাগে বণ্টন করতেন। একভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ প্রতিবেশীদের হাদিয়া দিতেন এবং একভাগ দরিদ্রদেরকে দিতেন। এভাবেই কোরবানি মুসলিম সমাজে উদ্যমতা তৈরি করে। ধনী-গরিবের পার্থক্য মিটিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে। ঈদের খুশিতে আন্দোলিত করে তুলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে।
কোরবানি মূলত ত্যাগের পরীক্ষা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দার অন্তর পরিশুদ্ধ করে থাকেন। তাই তো ঘোষণা হয়েছে যেন খাঁটি অন্তরে কেবল আল্লাহর জন্যই পশু জবাই করা হয়। নবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা দেখেন না তোমাদের মালদৌলত, দেখেন না তোমাদের বেশভ‚ষা, দেখেন শুধুই তোমাদের অন্তর আর আমলে পরিশুদ্ধতা।’ (মুসলিম : ২৫৬৪)। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্যে কোরবানি করার চেয়ে অন্য কোনো আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন কোরবানির এই পশুকে তার শিং, পশম ও খুরিসহ সব কিছু উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তায়ালার নিকট (কোরবানি) কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি কর।’ (তিরমিজি : ১৪৯৩)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোশত, আর না তাদের রক্ত বরং তার কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সুরা হজ : ৩৭)। তাই কোনো বান্দা যদি লোক দেখানো কিংবা গর্ববোধ করার তরে বড় অঙ্কের টাকায় কেনা কোরবানি দেয় এতে তার সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের পাল্লা আরও
ভারী হবে।
পরিশুদ্ধ নিয়তে কোরবানির অনেক ফজিলত রয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা তথা কোরবানি করা থেকে কোনো আমলই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় নয়। নিশ্চয়ই কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, চুল ও খুরসহ উপস্থিত হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট পৌঁছে যায়। সুতরাং তা দ্বারা নিজেকে সুবাসিত ও সুরভিত কর।’ (তিরমিজি : ১/২৭৫)। অন্য বর্ণনায় আছে, কোরবানিকারীদের জন্য কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে সওয়াব হবে। (তিরমিজি : ১/২৭৫; মুসনাদে আহমাদ : ১৮৮৫৭; ইবনে মাজাহ : ৩১২৬)
ঈদুল আজহায় কোরবানি করা ছাড়াও বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন
ঈদের দিন গোসল : ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। কারণ এ দিনে নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানরা ঈদগাহে একত্র হয়ে থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
উত্তম পোশাক ও সাজসজ্জা : ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ (যাদুল মায়াদ)। সামর্থ্য থাকলে নতুন পোশাক পরবে, অন্যথায় নিজের পরিষ্কার উত্তম পোশাক পরবে। হজরত নাফে (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দিন উত্তমভাবে গোসল করতেন, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করতেন, নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। অতঃপর নামাজে যেতেন। (শরহুস সুন্নাহ : ৪/৩০২)
ঈদগাহে যাওয়া : ঈদগাহে একপথ দিয়ে যাওয়া ও অন্যপথ দিয়ে ফেরা সুন্নত। (বুখারি : হাদিস ৯৮৬) সম্ভব হলে ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়াও সুন্নত। (ইবনে মাজা : হাদিস ১০৭১)
ঈদের নামাজ আদায় : ঈদের দিন সকালে পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বিশেষ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত তাকবিরসহ জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা এবং তারপর ঈদের খুতবা দেওয়া ও শ্রবণ করা। ঈদের নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করা উত্তম।
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- ১. হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামরা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেনÑ ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন; ২. ঈদ মোবারক ইনশাআল্লাহ; ৩. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
ঈদের তাকবির পাঠ : তাকবির পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবির হলো ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহ আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ বাক্যটি উচ্চঃস্বরে পড়া। পুরুষরা এ তাকবির উঁচু আওয়াজে পাঠ করবে, মেয়েরা নীরবে। এ তাকবির জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার পাঠ করা ওয়াজিব। (ফাতহুল বারি : ২/৫৮৯)
ঈদে খাবার গ্রহণ : ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে খেতেন না।’ (তিরমিজি : ৫৪৫)
এতিম ও অভাবীকে খাওয়ানো : ঈদের দিন এতিমের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্তে¡ও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহার : ৮)
আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া : ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। পাশাপাশি প্রতিবেশীরও খোঁজখবর নেওয়া। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক কর না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পাশর্^বর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাসদাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহংকারী।’ (সুরা নিসা : ৩৬)
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা : ঈদুল আজহায় পশুর রক্ত, আবর্জনা ও হাড় থেকে যেন পরিবেশ দূষিত না হয় সেদিকে প্রত্যেকের সতর্ক হওয়া উচিত। কোরবানি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত, আবর্জনা ও হাড় নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিতে হবে। বেশিরভাগ লোকই নিজস্ব জায়গায় পশু জবাই করে। এতে অলিগলিতে বর্জ্য যেমন পড়ে, তেমনি রক্ত পড়ে দূষিত হয় পরিবেশ, চলাচলের অনুপযোগী হয় রাস্তাঘাট। তাই ঈদুল আজহায় পশুর রক্ত, আবর্জনা পরিষ্কারে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ গ্রহণ করে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবেÑ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
ঈমানের অঙ্গ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ঈদ ও কোরবানিকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক