একাত্তর নিউজ ডেস্ক :
শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে গাঁজা ভর্তি ট্রাক ছাড়িয়ে দেয়ার জন্য কোনো অসৎ পুলিশ এই বার্তা দিয়েছে। কিন্তু ঘটনা একেবারেই আলাদা। কিছুদিন আগের এই ফেসবুক পোস্ট ভারতের আসাম পুলিশের আনুষ্ঠানিক ফেসবুক পাতাতেই লেখা হয়েছে।
শুধু আসাম পুলিশ নয়, কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর আর কেরালা পুলিশের ফেসবুক পেজ বা টুইটার অ্যাকাউন্টগুলো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কিছুদিন ধরেই। সেখানে গুরুগম্ভীর তথ্য একটু হাল্কা চালে, মজার ঢঙে দেয়া হয়, যা সামাজিক মাধ্যমের চালু রীতি।
আসাম পুলিশের ওই পোস্টটি দেয়ার আগের রাতে ধুবরী জেলায় একটি চেকপোস্টে ট্রাক ভর্তি প্রায় পাঁচশ কেজি গাঁজা আটক করা হয়। সেই খবর জানাতেই কিছুটা মজা করে আসাম পুলিশ লিখেছিল, কাল রাতে কি আপনার গাঁজা ভর্তি কোনো ট্রাক হারিয়েছে? আমরা ওটা খুঁজে পেয়েছি। ভয় নেই থানায় আসুন। ধুবরী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা নিশ্চই আপনাকে সাহায্য করবে।
গাঁজা ভর্তি ট্রাকের মালিক থানায় গেলে তাকে কী রকম খাতির করা হবে, সেটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারো! একই পোস্ট আসাম পুলিশের টুইটার হ্যান্ডেলেও লেখা হয়েছিল, যেটি পড়েছিলেন ২২ লাখ মানুষ আর রিঅ্যাকশন দিয়েছেন দুই লাখ ৬০ হাজারেরও বেশী মানুষ।
আসাম পুলিশ সামাজিক মাধ্যমে এরকমই নানা ধরনের পোস্ট করতে শুরু করেছে বছরখানেক ধরে। যার বার্তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা বা ছবির ব্যবহারে মানুষকে আকৃষ্ট করছে ব্যাপক ভাবে।
আসাম পুলিশের প্রশাসন বিভাগের অতিরিক্ত মহানির্দেশক হার্মিত সিং বলেন, আমরা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার শুরু করেছি সম্প্রতি। মাত্র গত বছর। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল আসাম পুলিশকে একটা নাগরিক-বন্ধু হিসেবে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকেই সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা শুরু হয়। সরাসরি যাতে যোগাযোগ বাড়ানো যায় নাগরিকদের সঙ্গে। তাদের চাহিদা মতো পরিষেবা দেয়া যায়।
সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ক্যাম্পেন চালানোর শুরুটা অবশ্য হয়েছিল একটা দুর্ঘটনা দিয়ে। আসাম পুলিশের ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসাবে কর্মরত সালিক খান বলেন, গতবছর যখন কার্বি আংলং জেলায় ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে দু’জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, সেই সময়ে আমি আসামেই ছিলাম। আমার তখনই মনে হয় পুলিশ তো সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারে এ ধরনের ভুয়া খবর বা গুজব রোধ করতে। আমি সিংয়ের কাছে গিয়ে জানিয়েছিলাম ব্যাপারটা। তার মনে ধরে যায়। তারপরেই শুরু হয় নানা ক্যাম্পেন – কখনও ভুয়ো খবর, কখনও মাদকবিরোধী প্রচার বা সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত।
শুধু আসাম পুলিশ নয়, সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে জনসংযোগের জন্য অনেকটা একই পদ্ধতি নিয়েছে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের পুলিশ বিভাগও।
কেরালা এখন ভারতের পুলিশ বাহিনীগুলোর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, পুণে আর কলকাতা বা দিল্লি পুলিশও।
কলকাতার ট্রাফিক পুলিশ যেমন বেশ কয়েক বছর ধরেই হেলমেট পরে মোটর সাইকেল চালানো বা গাড়ি চালানোর সময়ে মোবাইলে কথা না বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছোট ছোট ছড়া আর কার্টুনের মাধ্যমে দিতে শুরু করেছে।
আবার কেরালা পুলিশ তাদের ফেসবুক পাতায় প্রচুর মীম ব্যবহার করে। সেগুলোতে যেমন থাকে জনপ্রিয় সিনেমার ডায়লগ, তেমনই দেখা যায় জনপ্রিয় অভিনেতাদের চেহারাও।
রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে বাছাই করা পাঁচ জন পুলিশ কর্মীই কেরালা পুলিশের অতি জনপ্রিয় ফেসবুক-টুইটার চালিয়ে থাকেন। হার্মিত সিং বলেন, নাগরিকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলাটাই যেহেতু আমাদের মূল উদ্দেশ্য, তাই সামাজিক মাধ্যমে মানুষ যেভাবে কথা বলে, আমরা সেই ভাষায় লিখি বা সেরকম ছবি দিই।
পুলিশ বিভাগের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মজার ছলে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করার বিষয়টা নজর এড়ায়নি জনসংযোগ বিশেষজ্ঞদেরও।
পাবলিক রিলেশনস সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার কলকাতা চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান সৌম্যজিত মহাপাত্র বিবিসিকে বলছিলেন, গল্পের ছলে, কিছুটা মজা করে লেখর মাধ্যমেই ডিজিটাল মিডিয়ায় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয় নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলা হয়, সেগুলো মানুষের চোখ এড়িয়ে যায়। জনসংযোগের ক্ষেত্রে টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছতে হলে নতুন ভাবনা আনতেই হবে, যেটা বিভিন্ন পুলিশ বিভাগ শুরু করেছে।
পুলিশের ফেসবুক পাতাগুলোয় নিয়মিত অভিযোগও জমা পড়ে। তা ট্রাফিক সংক্রান্ত হোক অথবা আইন শৃঙ্খলা জনিত সমস্যার কথাই হোক।
সম্প্রতি সাবেক মিস ইন্ডিয়া ঊষসী সেনগুপ্তর গাড়ি চালকের ওপরে যখন কয়েকজন যুবক চড়াও হয়, সেই ঘটনার ছোট্ট একটি ভিডিও দিয়ে তিনি কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পাতায় লিখেছিলেন হেনস্থার কথা।
অনেক টালবাহানার পরে পুলিশ তার অভিযোগ গ্রহণ করলেও ততক্ষণে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়। তারপরেই নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন।
‘সামাজিক মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে দিয়ে আমরাও কিন্তু রেকর্ড সময়, মাত্র ৫৭ মিনিটের মাথায় একটা গাড়ি চুরির ঘটনার সমাধান করতে পেরেছি। গাড়িটাও উদ্ধার হয়েছে, চোরেরাও গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে সবথেকে বড় সাফল্য এসেছিল যখন একটি কিশোরীকে আত্মহত্যা করার আগেই আমরা উদ্ধার করতে পারি। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমাদের সতর্ক করার আধঘন্টার মধ্যেই পুলিশ গিয়ে ওই মেয়েটিকে বাঁচায়,’ বলছিলেন হার্মিত সিং।
শুধু অভিযোগ নয়, অনেক তথ্যও পাওয়া যায় সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে, বলছিলেন আসাম পুলিশের ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট সালিক খান। সেগুলোর জন্য অবশ্য প্রকাশ্য সামাজিক মাধ্যম নয়, হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বর রয়েছে প্রায় সব পুলিশ বিভাগেরই। বিবিসি বাংলা।