দেশি পশুতেই মিটবে কোরবানির চাহিদা

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128

একাত্তর নিউজ ডেস্ক:  আর মাত্র দিন দশেক পরেই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এবারের ঈদে কোরবানির পশুর কোনো ঘাটতি হবে না দেশীয় পশুতেই মিটবে কোরবানির চাহিদা। ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু রফতানি কমে যাওয়ায় ও সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করায় গত কয়েক বছরে দেশি পশু পালন বেড়েছে। তার সুফল মিলছে এখন। নানা উদ্যোগে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে গরু ও ছাগল উৎপাদনে। গত এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে একটা সময় কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের বাজারে ভারতীয় গরুতে সয়লাব হয়ে যেত। কিন্তু সে দৃশ্যপট এখন পাল্টে গেছে। প্রতিবছরই ভারত থেকে গরু আমদানি কমছে। এটিকে দেশের ডেইরি শিল্পের জন্য খুবই ভালো খবর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. হিরেশ রঞ্জন ভৌমিক সময়ের আলোকে বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশে গরুর রফতানির বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করাতে সুফল পাচ্ছেন দেশের ক্ষুদ্র খামারিরা। একসময় দেখা যেত কোরবানির ঈদে কোরবানির গরুর অর্ধেকই আসত ভারত থেকে। কিন্তু এখন ভারত থেকে গরু আসার হার একেবারে কমে গেছে। এর সুফল হিসেবে চাষি ও খামারিরা পশুর দাম বেশি পাচ্ছেন। ফলে পশু পালনে বাংলাদেশে সফলতা এসেছে। সরকার এ বিষয়ে নানা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কোরবানির ঈদে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বেশি পশু মজুদ আছে। ভারত থেকে কোরবানির পশু আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। এখন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত কোরবানির ঈদে প্রস্তুত থাকা ১০ লাখ পশু অবিক্রীত ছিল। আশা করা হচ্ছে, এবারও চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশু অবিক্রীত থাকবে।

ভারত থেকে গরু আসার একটি চিত্র গত মাসে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে জমা দেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ঈদের আগে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে বিজিবি যে তথ্য জানায় তাতে দেখা যায় ২০১৩ সালে যেখানে ভারত থেকে ২৩ লাখ গরু আমদানি করা হয়, সেখানে চলতি বছরের ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ভারত থেকে গরু এসেছে মাত্র ৯২ হাজার। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১৩ সালের পর থেকেই প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে ভারত থেকে গরু আমদানি কমেছে। যেমন ২০১৪ সালে আমদানি হয় ২১, ২০১৫ সালে ১৭, ২০১৬ সালে ১১, ২০১৭ সালে ১৩ লাখ এবং ২০১৮ সালে ভারত থেকে গরু আমদানি করা হয় মাত্র ৭ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ছয় মাসে যেহেতু মাত্র ৯২ হাজার গরু এসেছে ভারত থেকে, সেহেতু এ বছর শেষে গরু আসার সংখ্যা সর্বোচ্চ দেড় থেকে ২ লাখ পর্যন্ত হতে পারে।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ড. এবিএম খালেদুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ভারত সরকারের গরু রফতানির ওপর কড়াকড়ি করার বিষয়টি বাংলাদেশি খামারিদের জন্য সৌভাগ্যের বার্তা হিসেবে এসেছে। কারণ এতে করে বাংলাদেশের ডেইরি শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে, খামারিরা গরু পালন করে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে এখন দেশি উৎস থেকে পাওয়া পশুতেই কোরবানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভারতীয় গরু যদি একেবারে না আসে তাতেও আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে এবারের কোরবানির ঈদ আসতে এখনও দিন দশেক বাকি। এ সময়টাতে যেন অবৈধপথে ভারতীয় গরু আসতে না পারে সে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে।

দেশীয় খামারিরা এবারের ঈদে পশু বিক্রির সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছেন। এখন তারা কোরবানির পশু বিক্রির সময় গুনছেন। ইতোমেধ্য দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের পশুর হাটগুলোয় আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। এবারও দেশীয় পশুতে কোরবানির চাহিদাও মিটবে বলে আশা করছেন খামারিরা। তাদের চাওয়া, যেন দেশের বাইরে থেকে পশু আমদানি না করা হয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য দেশ ১ কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩টি পশু প্রস্তুত আছে। এর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩ এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭২ লাখ। সরকারি আটটি খামারে উট-দুম্বাসহ কোরবানির প্রাণী আছে আরও সাত হাজার। গত বছর কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি ১৫ লাখ পশু। এর মধ্যে ছাগল-ভেড়া ছিল ৭১ লাখ। গরু ৪৪ লাখ।

দেশে গত বছরের চেয়ে গরুর উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার, আর ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ। এর আগে ২০১৭ সালে কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ ২২ হাজার পশু। ধারাবাহিকভাবে দেশে গরু-ছাগলের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৮ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে দ্বাদশ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এককভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়।

এদিকে, বাংলাদেশে মোট নিবন্ধিত খামার ৬৬ হাজার, অনিবন্ধিত ৭০ হাজার। সবমিলে খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজার। এসব খামার থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হাতে এসে পৌঁছে গেছে কোরবানির পশুর তথ্য। সবমিলে ১ কোটি ১৭ লাখ পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত। সর্বোচ্চ ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এবারও সাত লাখ পশু অবিক্রীত থেকে যেতে পারে।

২০১৪ সালে ভারত সরকার এ দেশে গরু আসা বন্ধ করে দেয় হঠাৎ। এরপর গরু মোটাতাজাকরণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে আড়াই শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয় খামারিদের। ওই সুবিধা পেয়ে সারা দেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার তরুণ গরুর খামার গড়ে তোলেন। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত খামারির সংখ্যা হচ্ছে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬ জন। সারা দেশে গরু-ছাগলের খামার গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় লাখ। ফলে গরু-ছাগলের উৎপাদন বাড়ছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সম্প্রতি সারা দেশে গরু-ছাগলের চাষ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে একটা সাড়া পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। দারিদ্র্যবিমোচন নিয়ে যেসব এনজিও কাজ করছে, তাদের অধিকাংশ এখন ঋণ দিচ্ছে গরু পালনে। এ খাতে বিনিয়োগ করছে ব্যাংকগুলোও। এতে গরু পালন বেড়েছে অনেক দ্রæত। চামড়া শিল্পেও রফতানি আয় বাড়ছে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ইমরান হোসেন বলেন, দেশি গরুর চাহিদা বাড়ায় শিক্ষিত তরুণ ও প্রবাসীরা গবাদিপশুর খামারে বিনিয়োগ করছেন। গরু আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। কোরবানির হাটে ক্রেতারা দেশি গরু খোঁজেন হন্য হয়ে। তারা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মোটা করা বিদেশি গরু কিনতে চান না।

Please follow and like us: