মো: আ: হামিদ মধুপুর(টাঙ্গাইল)প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বেরীবাইদ ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া গ্রামে কলাগাছ আর আনারসের পাতা দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে হস্ত শিল্প।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসতেছি পরিত্যাক্ত কলাগাছ আর আনারসের পাতা দিয়ে তেমন কোনো কাজের যোগান হিসেবে বহন করা হতো না। এমনকি বিগত ৫ বছর আগেও পরিত্যাক্ত কলাগাছ আর আনারস পাতা অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হিসেবে গণ্য করা হতো। আর সেই পরিত্যাক্ত কলাগাছ আর আনারস পাতা এখন মধুপুরের জাঙ্গালিয়ায় অধিক অপার সম্ভাবনার খাত হয়ে উঠেছে। এখন এগুলো থেকে তৈরি করা হচ্ছে সৌখিন সব পন্য। এ সব পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এ হস্তশিল্পের জন্য টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার জলছত্রের জাঙ্গালিয়া গ্রামে তৈরি হয়েছে পূর্ণাঙ্গ একটি কারখানা। যেখানে কাজ করছেন শতাধিক দরিদ্র মহিলা-নারী। আর বর্তমানে পুরুষেরাও এই কাজের দিকে ঝুঁকছে। আর এসব হস্তশিল্পের পন্য তৈরি করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছেন এখানকার নারী পুরুষেরা। বলা হয়ে থাকে, আনারসের রাজধানী হচ্ছে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলা ।
এখানে আনারসের পাশাপাশি কলাচাষও হয় ব্যাপক। আর একসময় ফল দেওয়ার পর কলাগাছ ও আনারস পাতা ফেলে দেয়া হতো।কিন্তু এখন ফেলে দেয়া কলাগাছ আর আনারসের পাতা দিয়ে তৈরী হচ্ছে এখন নানা রকম সৌখিন পন্য। আর এই কাজটি শুরুতে অনেক কঠিন মনে হলেও বর্তমানে কাজটি এখানকার লোকদের আয়ত্বে চলে এসেছে। উল্লেখ্য যে, পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এসব পন্য দেশের সীমানা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। এগুলো রপ্তানি করা হচ্ছে।
এদিকে ২০১৭ সালে উপজেলায় এই হস্তশিল্পের কারাখানা শুরু হয়েছে। এসব পরিত্যাক্ত কলাগাছের বাকল আর আনারসের ফেলে দেয়া পাতা থেকে যেসব জিনিস তৈরি হচ্ছে সেগুলো হচ্ছেঃ টিসু বক্স, ডেক্স অর্গানাইজার, নেট, পর্দা, ফ্লাওয়ার বক্স, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, চাবির রিংসহ নানা রকমের সৌখিন পন্যসামগ্রী। আর গ্রামের নারীদের দক্ষ হাতে তৈরি হওয়া আকর্ষনীয় এসব পন্য যাচ্ছে চীনসহ উন্নত দেশগুলোতে। আর এখানে কাজ করা নারীরা হয়ে উঠছে স্বাবলম্বী। উল্লেখ্য যে, আগে যে সব মহিলার বনে-জঙ্গলে কলা ও আনারনের বাগানে কাজ করে যে টাকা আয় করতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করেন এই হস্তশিল্পে কাজ করে। কারখানায় প্রত্যক্ষভাবে গিয়ে দেখতে পেলাম, “এখানে কর্মীরা কলা গাছ ও আনারসের পাতা থেকে আঁশ বের করে পানিতে ধুয়ে পরিস্কার করছেন। তারপর ভেজা আঁশ আবার রৌদ্রে শুকাচ্ছেন। আরও একটি বিষয়, কারখানায় নারী কর্মীরা দলবদ্ধভাবে কাজ করছেন।এখানে কেউ রং করছেন, কেউ আঠা লাগিয়ে টিস্যু বক্স, চাবির রিং, ডেক্স অর্গানাইজার, নেট, পর্দা, ফ্লাওয়ার বক্স, আবার কেউ ওয়াল হ্যাঙ্গিংসহ নানা প্রকার পণ্যের কাজ করছেন।” তারপর ফিরোজ নামের এক কর্মী জানিয়েছেন, ” আমরা ফেলে দেয়া কলাগাছ ও আনারসের পাতা থেকে এ সুন্দর হস্তশিল্প হতে পারে তা কখনও জানতাম না।কিন্তু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব জানতে পেরেছি যে, মেশিন দিয়ে কলা গাছ ও আনারসের পাতা থেকে আঁশ বের করা হয়।তারপর এই আঁশ দিয়ে কর্মীরা টিসু বক্স, ডেক্স অর্গানাইজার, নেট, পর্দা, ফ্লাওয়ার বক্স, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, চাবির রিংসহ নানা পন্য তৈরি করা যায়”। অপরদিকে এখানকার প্রশিক্ষক রিমা হাজং গারো জানিয়েছেন যে,”এখানকার নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন সৌখিন জিনিসপত্র তৈরী করানো হচ্ছে। ফলে তারা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। আর আগে যারা বন, আনারস ও কলা বাগানে কাজ করতো সেসকল নারীরাও আমাদের এখানে কাজ করছেন।” নারী উদ্যোক্তা ও বুরো ক্রাফটের মুখ্য সমন্বয়ক রাহেলা জাকির আমাদেরকে বলেছেন ,” এসব ফাইবার দিয়ে এতো সুন্দর হস্তশিল্প তৈরী হয় এটা আমাদেরও জানা ছিলনা। এটা বাজারজাত হতে পারে বা নারীদের কর্ম সংস্থান হতে পারে সে বিষয়ও ছিলো কল্পনাজগতেরও বাহিরে। তবে এই হস্তশিল্প মধুপুরের জাঙ্গালিয়ায় করার কারন হলো এখানে অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করেন। আর পিছিয়ে পড়া দরিদ্র নারীদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ দেয়া যাবে। আর এই কারণেই মধুপুরে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বর্তমানে শতাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে হাজার হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান” বিশ্বের প্রখ্যাত দেশ চীনেতে একটি মেলায় অংশ গ্রহণ করেছিলাম, তখন বেশ কিছু অর্ডার পাই। এছাড়াও আরো অনেক দেশই হস্তশিল্পের এ পণ্য গুলো নেয়ার জন্য অনেক আগ্রহ দেখিয়েছেন। অপরদিকে কলা গাছ ও আনারসের কিছু পাতা আছে যেগুলো দিয়ে আঁশ বানানো সম্ভব হচ্ছে না। আর সেগুলো দিয়ে আমরা সহজেই টিস্যু পেপার বানাতে পারবো। তাছাড়াও ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস বানানোর চিন্তাভাবনা মাথায় রেখেছি। এমনকি বজ্র দিয়ে খাম বানানোও সম্ভব।” পরিশেষে বলা যায় যে, ” পরিত্যাক্ত প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পরিবেশ বান্ধব এসব পন্য পঁচনশীল হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বহিঃবিশ্বে। আর সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচর্যা পেলে বহির্বিশ্বের দরবারে আলাদা স্থান করে নিতে সক্ষম হবেই টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের এসব পরিবেশ বান্ধব এ সকল পন্য। যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এখানকার সকলেরই কাম্য।