- –:একাত্তর সম্পাদকীয় মুক্তচিন্তা:–
হুঁশিয়ার ও সাথী, কৃষাণ, মজদুর, ভাইসব হুঁশিয়ার——-ডি এম, শাহিদুজ্জামান
“বাঙলার হিন্দু, বাঙলার মুসলিম, বাঙলার বৌদ্ধ, বাঙলার খৃষ্টান, আমরা সবাই বাঙালী”
ভারত এবং বাংলাদেশে বসবাসকরী হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রোপাগান্ডা মূলক এক ধরণের স্নায়ুবিক ছায়া যুদ্ধ শুরু হয়েছে । তাদের প্রোপাগান্ডার মূল উপজীব্য উভয় দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় দ্বারা আক্রান্ত ।
কিছু নাম ঠিকানাহীন অনলাইন পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে উভয় দেশের এক শ্রেণীর মানুষ এই জঘন্য মরণঘাতী প্রচারে নেমেছেন । এই পোষ্ট গুলো দিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি নষ্ট করা হচ্ছে, এক ধরণের সাম্প্রদায়িক মানুষ ভারত এবং বাংলাদেশের এই ধরণের ঘটনা ফেসবুকে বেশী বেশী করে পরিকল্পিত ভাবে তুলে ধরছে, আর কিছু মানুষ বুঝে হোক অথবা না বুঝে হোক সেটি শেয়ার করে ধর্মীয় ভাবাবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে অথবা নিজেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বলিষ্ঠ কন্ঠ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল এই অপশক্তির ক্রীড়ানক হিসাবে কাজ করছেন, যা আমাদের হাজার বছরের ধর্মীয় সহনশীলতার, পারষ্পরিক বন্ধন, বিশ্বাস, ঐতিহ্য এর উপর আঘাত করছে । জানিনা এর ভবিষ্যত কি !
বিজেপির মদদ পুষ্ট আরএসএস, বজরং দল সহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভারতের সংখ্যা লঘু মুসলমানদের উপর হামলে পরেছে এবং নির্যাতন মূলক আচরণের মাধ্যমে “জয় শ্রীরাম” সহ বিভিন্ন ধর্মীয় শ্লোগান বলিয়ে ও সেটি ভিডিও করে অনলাইনে ছড়াচ্ছেন তাতে এটা পরিস্কার বিষয়টি তাদের দেশের আগামী বিধান সভার ও স্হানীয় নির্বাচনকে ঘীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত ।
আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় মৌলবাদী অপশক্তি, স্বাধীনতা বিরোধীরা অন্য কোনও ভাবে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে পেরে উঠতে না পেরে সাম্পদায়িকতার সেই পুরাতন গুলি চালানো শুরু করেছে ।
আমাদের দেশের গুটিকয়েক মৌলবাদী- জঙ্গি- সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু বর্তমানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বেশীর ভাগ ঘটনায় ঘটছে ভুয়া অনলাইন পোটালের রেফারেন্স দিয়ে ফেসবুকে বারবার পোস্ট দেওয়া ঘটনা গুলির জন্য । সরকারের নির্লিপ্ততা তাদের এই নগ্ন খেলায় মদদ দিচ্ছে।
আসুন সকলে সতর্ক হয়, সচেতন হয়, দায়িত্বশীল হয় এবং সর্বনাশী এই ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের কে গুটিয়ে তুলি ।
প্রকৃত ধার্মিক কখনও সাম্প্রদায়িক হন না, বক ধার্মিকই সাম্প্রদায়িক, কারণ ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে তারা নিজের আখের গোছাতে চায় ।
সাম্প্রতি প্রিয়া সাহা নামে এক সংখ্যালঘু মহিলাার মার্কিন মোড়ল ট্রাম্পের কাছে নিজ দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে নালিশ করেছেন এ ভিডিওচিত্র আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক সকল মানুষ ভাইরাল করে ফেলেছেন ।
এটা অস্বীকার করার উপায় নাই প্রিয়া সাহা জঘন্য কাজ করেছেন । নিজ দেশের বিরুদ্ধে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী দখলবাজ যুদ্ধবাজ একটি রাষ্ট্রের ততোধিক উগ্র খামখেয়ালী ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিদ্বেষী রাষ্ট্রনায়কের কাছে নালিশ এবং নিজ দেশে বিদেশী যুদ্ধবাজ অমানবিক পরাশক্তির হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রদোহিতার সামিল ।
কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধ এর আগেও অনেকেই করেছেন । সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মার্কিন মুলুকের পত্রিকায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিবন্ধণ লিখেছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধ করেছেন ড. ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে বাঁধা পেয়ে হিলারী ক্লিনটনকে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন, একই অপরাধ করেছে তারেক জিয়া, ব্যরিষ্টার রাজ্জাক, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহা সহ বিএনপি ও জামাতের অসংখ্য নেতা কর্মী ।
নিঃসন্দেহে নিজ দেশে বিদেশি পরাশক্তির এরূপ হস্তক্ষেপ কামনা করা বড় ধরণের রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের দ্বায়ে এদের সবার বিচার দাবী করি আমরা ।
প্রিয়াসাহা অভিযোগ করছেন কার কাছে এবং কোন সভায় ?
মধ্যপ্রাচ্য সহ সারা বিশ্বে নিজেদের অস্ত্র বিক্রি ও তেল-সোনা খনিজ সম্পদ লুন্ঠনের জন্য, নিজদেশ সহ সারা বিশ্বে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, ধমীয় বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে দিয়ে নিজের কুখ্যাতী ছড়িয়ে দিয়েছেন যিনি, সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর কাছে এবং হাস্যসকর ৪০ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সভায়, আরও মজার ব্যাপার যে সভায় সরকারি উদ্যোগে প্রেরিত প্রতিনিধি দলের (বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের নির্ধারিত) তিন ধর্মের তিনজন সদস্য কোনও অভিযোগ করেননি, তারা বাদে, স্বউদ্যোগে ঐ সভায় যাওয়া প্রিয়া সাহা । তার দুই মেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করলেও সে কোনও প্রতিনিধি দলের সদস্য না হয়েও কিভাবে হোয়াইট হাউজের মতো নিরাপত্তার টোপরে মোড়া স্থানে প্রবেশ করে বিশ্ব মোড়লের কাছাকাছি প্রবেশ করলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেকেই পড়া শোনা করেন, তাদের সবার পক্ষে কি ট্রাম্পের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ? তা হলে প্রিয়া কি ভাবে পৌ্ছালেন সেটিও তদন্তের বিষয় । এটা মধ্যপ্রাচ্য দখল নেওয়ার মতো আমাদের দেশও দখল নেওয়ার বর্তমান ভারত-মার্কিনী কোনও চক্রান্ত না তো ?
প্রিয়া সাহা বলেছেন, তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি কোনো বিচার পাননি । একথা তো একশ ভাগ সত্য । পিরোজপুরে তার গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা এবং সত্যিই তিনি কোনো বিচার পাননি । প্রয়োজনে সরকার তদন্ত করে প্রমাণ করে দিক এধরণের ঘটনা ঘটেনি, তার অভিযোগ মিথ্যা । (পুনশ্চঃ যদিও আমার এ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর মাননীয় মন্ত্রী মহাদয় পিরোজপুরের এমপি শ ম রেজাউল করিম বলেছেন পিরোজপুরে প্রিয়া সাহার কোনও জায়গা জমিই নেই অতএব পোড়ানোর কোনও প্রশ্নই আসেনা, বিষয়টি যেন সত্যি হয়)
প্রিয়া সাহা একজন সংগ্রামী নারী, কিন্তু তিনি এভাবে বিদেশি পরাশক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করে তার এতোদিনের সব সংগ্রামকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে, তিনি বিদেশী ক্রীড়াণকে নিজেকে পরিনত করেছেন ।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন সব সরকারের আমলেই হয়েছে এটা চরম সত্য কথা কিন্তু এটার মাত্রা অতিক্রম করে বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে । প্রতিনিয়তই খুন, ধর্ষণ, ভূমি দখল, উচ্ছেদ, মন্দির ভাংচুর, মন্দিরের জমি দখল, বিগ্রহ ভাংচুর, দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ঘটছে । বিএনপি-জামাত আমলে এগুলো হয়েছে সংগঠিতভাবে, অনেকখানি দলীয় সিদ্ধান্তেই । আর আওয়ামী লীগের আমলে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভাবে, ব্যক্তিসার্থ হাসিলের জন্য । এরজন্য যেমন ভোট ব্যাংকের কেরামতি দায়ী, ঠিক তেমনি সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি ও ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পলায়নপর মনোবৃত্তি, ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয়ের ব্লাঙ্ক সুবিধা দেওয়াও আনেক খানি দায়ী ।
সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ এই সরকরের আমলেও বারবার হয়েছে । রামু, নাসিরনগর, গড়েয়া, মালোপাড়া, ঠাকুরপাড়া সহ অনেক অপ্রকাশিত স্থানে । সেগুলো দলীয় সিদ্ধান্তে নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন এমনকি কতিপয় বর্তমান ও প্রাক্তন মন্ত্রী-এমপিদের সংশ্লিষ্টতার বিস্তর ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য আক্রমণকারীদের স্বচিত্র ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও এগুলোর একটারও বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি, এমনকি যে পূর্ণিমা রাণী শীলকে বিএনপি-জামাতের দলীয় ও সরকারি সিদ্ধান্তে সংখ্যালঘু নারী নির্যাতনের শিকারের প্রতীক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, সেই পূর্ণিমার মামলার আসামীরাও জামিন পেয়ে যাচ্ছে এই সরকারের আমলেই ।
এদেশের সংখ্যালঘুদের ৯৫ শতাংশই ‘এখনও পর্যন্ত’ নৌকায় ভোট দেন, কারণ তাদের কাছে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো বিকল্প নাই তাই, সেই জন্যেই কি তাদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ।
আমরা যেমন প্রিয়া সাহার রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক প্রোপাগান্ডার বিচার চায়,
ঠিক একইভাবে রামু, নাসিরনগর, ঠাকুরপাড়া, গড়েয়া, মালোপাড়ার ঘটনার বিচার চায় ।
আমরা যেমন প্রিয়া সাহা এবং তার স্বামী মলয় সাহার বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত ও বিচার চাই,
ঠিক একইভাবে আজ ট্রাম্প-প্রিয়ার কথোপকথনের ভিডিও প্রকাশের পর প্রিয়া সাহাকে যারা প্রকাশ্যে আইনকে হাতে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের আগ্রহ ব্যক্ত করছেন, তাদেরও বিচার চায় ।
ভুলে যাবেন না এই ঘটনাটিকে ঘীরে উভয় দেশের একশ্রেণির সাম্প্রদায়িক মানুষ পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে । উভয়েই যার যার ওয়ালে পোষ্টটি তুলে ধরছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে । কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এদেশের সংখ্যালঘু এমপি, মন্ত্রীদের বিশেষ নজরদারীতে রাখার দাবী তুলেছেন, কেউ কেউ সকল সংখ্যালঘুকে ঘাড় ধরে বার করে দেওয়ার দাবী তুলেছেন । এ কিসের লক্ষণ ? আজ ভারতের বিজেেপি সরকার এবং তাদের দোষররা যেভাবে তাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এনআরসি’র নামে সেদেশ ছাড়া করার চক্রান্ত করছে একি তারই প্রতিধ্বনি নয় । ভেবে দেখুন তো মিয়ানমারের ৭লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আমাদের নাভিশ্বাস অবস্থা, সেখানে কোটি কোটি ভারতীয় মুসলিম কে আশ্রয় দিয়ে আমরা কোথায় যাবো ?
তাই সকল অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের প্রতি আহ্বান স্বার্থান্বেষী, সাম্প্রদায়িক, একচোখা, ধর্মান্ধ প্রোপাগান্ডাকারীদের মিথ্যা প্রচারণায় কান দেবেন না । আমাদের দেশ আমাদেরই । তাই আসুন, ত্রিশলক্ষ শহীদের ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চার নীতিকে ফিরিয়ে এনে, সাম্প্রদায়িকতা লাথি মারি ।
“তাই আহ্বান দিকে দিকে,
নয় আর দেরি নয়,
সময় তো নেই আর ভাইরে,
জোটটাকে আমাদের বজ্রকঠিন কর, তুলে নাও হাতিয়ার ভাইরে”——–