“দীপান্বিতার চিঠি —২”
————————সুনন্দা শিরিন
তোমার চিঠিটা পেয়েছি অনির্বাণ।
আজ দু’দিন ধরে কম করে হলেও
অন্তত পঞ্চাশবার পড়েছি।
পুরো চিঠি জুড়ে কেবলই অভিযোগ
যেনো সব ভালো তুমি একাই বেসেছিলে।
টি এস সি চত্বরে দাঁড়িয়ে
রং চায়ে হাত পোড়ানোর সন্ধ্যাটাও টেনেছো
খুব গুছিয়ে চিঠির ভাঁজে।
গরম চা পরে হাত পোড়ায়
আমার ভালোবাসা দায়ী ছিলো না অনির্বাণ।
ছিলো তোমার
আমাকে ভেদ করে
আমারই বন্ধু পলাকে দেখে নেয়ার
অবাক দৃষ্টি।
ভীষণ মুগ্ধতা ছিলো সেদিন তোমার পুরো অবয়বে
পলাকে দেখে নেয়ার।
তোমার মুগ্ধতায় ভিজেছিলো
আমার দু’চোখ।
তোমরা ব্যস্ত ছিলে
কতোটা পুড়লো গরম চায়ে সেটা দেখে নিতে।
অভিযোগে অভিযোগে পুরো চিঠি শেষ করেছো।
অথচ চিঠির ভাঁজে
সিঁদুরের দাগ স্পষ্ট।
জানি না এটা পলারই সিঁদুর কিনা,
নাকি অন্য কারো।
অনির্বাণ, মনে পড়ে
খেলা ছিলো আমার ভীষণ প্রিয়।
স্টেডিয়ামের সিঁড়িতে বসে তুমি যখন
বিভোর হয়ে খেলা দেখছো
আমি দেখছি তোমায়।
আমার দু’চোখ জুড়ে কেবল ছিলে তুমি
তুমিময় সুখ।
অনির্বাণ, মনে পড়ে,
মনে পড়ে?
গেলোবার শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় তুমুল বৃষ্টি
তুমি কাক ভেজা হয়ে দরজায় কড়া নাড়লে।
দরজা খুলে ঝোড়ো বৃষ্টি আটকাতে
জানালা গুলো লাগিয়ে
ঘুরে দাঁড়াতেই ——————–
আমার পা আটকে গেলো ঠিক ওখানেই।
এক অন্য অনির্বাণকে দেখছি আমি!
খুব দৃঢ় ঠান্ডা গলায় বললে——
“এবার ভেতরের ঝর আটকাবে কি করে দীপা?
আমি যে তোমায় ভেজাতে এসেছি
ভিজবে না?
একটা দু’টো জানালা বন্ধ করে কি হবে বলো
ভিজে যাক আমাদের সবকিছু,
তবুও জানালা বন্ধ করো না আজ।
খুলে না-ও
যা কিছু, ছিড়েখুঁড়ে খাও
মিশে যাও জলের মতো।”
মনে পড়ে, মনে পড়ে অনির্বাণ
তোমার আমার একসাথে আকাশ দেখার
সেই শরৎ সন্ধ্যা গুলো?
মনে পড়ে, মনে পড়ে
সেই সন্ধ্যায়
চাঁদের কতোটা কাছে গিয়েছিলাম তুমি আমি,
কতোটা এসেছিলে দ্বিধাহীন
নিশ্বাসের কাছাকাছি?
তোমাকেই দিয়েছিলাম শব্দের নিখুঁত বুনন
যত গোপন অনুভব।
মায়ার পেখম মেলে নিষিদ্ধ সীমানায়
ডেকেছিলে যে সুরে,
সেখানেই ফেলেছি নোঙর ভালোবেসে সবটুকু।
চাঁদকে ঘিরে
ভাঙ্গা মেঘের সে কি প্রেম!
হালকা বাতাসেও
বারবার মেঘ লুকিয়ে নিচ্ছে
চাঁদকে তার নিজের বুকে।
বলিনি কখনো
ঠিক এমনই ভালোবাসা চেয়েছিলাম তোমাতে আমি।
মনের হিমঘরে
দুরত্বের ধূপকাঠি জ্বালিয়ে
আজ তুমি অংক কষছো
কতোটা দিলে ভালোবাসা সেটা জানাতে।
পুরো চিঠি জুড়ে
কখন কতোটা দিয়েছো তার নিখুঁত হিসেব।
কতোটুকু সময়, কতোটা সমুদ্র দিয়েছো ঢেলে
সবটুকু আয়নার মতো জ্বলছে চিক চিক।
হিসেব রয়নি শুধু
দীপান্বিতার বধির ভালোবাসার।
জানায়নি,
বুভুক্ষুর মতো খুঁজে মরার
নিদারুণ সেই চৈতী খরা,
নির্ঘুম রাতের নৈশব্দের আশ্চর্য জাগরণ।
তুমি অনন্ত ঘোর লাগা দৃষ্টি তার
অলিখিত ভালোবাসা, অসম্ভব পিছুটান।
শূন্যতা যেখানে অনুভবের প্রদীপ জ্বালে
পোড়ে ভেতরবাড়ি,
জলমগ্ন সাঁতার সে আর কাটে কতোটা!
ইচ্ছের বুদবুদে ডাকে না কাছে আর
জ্যোৎস্নার প্রদীপে নিবিড় নিরালায়।
ভালোবাসতে একটা জীবন
পুড়িয়ে ফেলতে পারে কেবল দীপান্বিতারাই।
দীপান্বিতারাই পারে
অপেক্ষা করে করে ভালোবাসাকে ফেরাতে।
ঠোঁটে খড়কুটো রেখে
বুনতে পারে মেঘের বাড়ি।
মেঘের মতোই কেঁদে কেঁদে
অনির্বাণের বুকে ঝরাতে পারে
ভীষণ বৃষ্টি।
তুমুল ভালোবাসার অবহেলা সহ্য করেও
তার অপেক্ষায়ই ভেজাতে পারে চোখ।
অনির্বাণের টানা সমাপ্তি নিয়েও
মনের সমাপ্তি পারে না টানতে।
নির্ঘুম অপেক্ষায় জ্বেলে রাখে লন্ঠন
যদি ফেরে সে কখনো
সব ছেড়ে ছুঁড়ে
একলা একা
ফেলে যাওয়া পুরোনো
পরিচিত সেই পথে।।