শেখ গফ্ফার রহমান, স্টাফ রিপোর্টারঃ
যশোর-সদর উপজেলার শিল্পাঞ্চল ও ফলের রাজ্যখ্যাত বসুন্দিয়ার লিচুর হাট জমে উঠেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাটটি লিচু চাষি, বাগান মালিক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে জমজমাট থাকে।
চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, বসুন্দিয়া বাজারে প্রতিদিন ৫০-৬০ লাখ লিচু বিক্রি হচ্ছে। এতে এক থেকে দেড় কোটি টাকা লেনদেন হয়। এক মাসের বেশি সময় এই বাজারে প্রতিদিন লিচু বিক্রি করবেন চাষিরা। এখান থেকে লিচু কিনে খুলনা,ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রংপুর ও বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠান ব্যাপারীগণ।
এ ববছরের হিসাবে যশোরে ৬৪৯ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) আবু তালহা সাংবাদমাধ্যমকে। তিনি বলেন, এর মধ্যে যশোর সদরে সর্বাধিক ২৬৪ হেক্টর। আবহাওয়াগত কারণে গতবারের তুলনায় এবার ফলন কম হয়েছে। ইতোমধ্যে আগাম জাতের লিচু বাজারে উঠেছে। এ ছাড়া, বোম্বাই মোজাফ্ফর চায়নাথ্রী প্রভৃতি জাতের লিচু চাষ হয়েছে। সেগুলো আরও কিছুদিন পর পাকবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে ভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, আলমসাধু ও গাড়িতে করে বাজারে লিচু আনছেন চাষিরা। এরপর গাড়ি থেকে ঝুড়ি নামিয়ে সাজানো হয়। দুপুর থেকে শুরু হয় জমজমাট বেচাকেনা। বিকাল ৫টা পর্যন্ত বাজার পরিপূর্ণ থাকে।
এক মাসের বেশি সময় এই বাজারে প্রতিদিন লিচু বিক্রি করবেন এই অঞ্চলের চাষিরা, বসুন্দিয়ার বিভিন্ন গ্রামের লিচুবাগানে গিয়ে দেখা গেছে, চাষিরা গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন। পরে গণনা করে আঁটি বাঁধছেন। এরপর ঝুড়িভর্তি করে ভ্যান, রিকশা ও গাড়িযোগে বসুন্দিয়া বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন। বসুন্দিয়া বাজারে প্রতিদিন ৫০-৬০ লাখ লিচু বিক্রি হচ্ছে
চাষিরা জানিয়েছেন, এবার বৈশাখ মাসে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় প্রতিটি বাগানের লিচু গাছে ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে দাম ভালো পাচ্ছেন।
দুই শতাধিক গাছের ১১টি বাগান লিজ নিয়েছেন বাঘারপাড়া উপজেলার রাধানগর গ্রামের লিচু চাষি মুরাদ হোসেন। এ পর্যন্ত এসব গাছ থেকে চার লাখ লিচু বিক্রি করেছেন জানিয়ে মুরাদ বলেন, ‘সোমবার প্রতি হাজার লিচু ১৭৫০ টাকা বিক্রি করেছি। মঙ্গলবার প্রতি হাজার ২২০০ টাকায় বিক্রি করেছি। আবহাওয়া শুষ্ক থাকলে অর্থাৎ বৃষ্টি না হলে এবার সব খরচ বাদ দিয়ে তিন লাখ টাকার মতো লাভ করতে পারবো।’
বসুন্দিয়া ও আশপাশের গ্রাম ছাড়াও বাঘারপাড়া, অভয়নগর, নড়াইল থেকে বিভিন্ন যানবাহনে লিচুবোঝাই করে আড়তে নিয়ে আসেন চাষি এবং বাগান মালিকরা।
আশপাশের ১০-১৫টি গ্রাম থেকে প্রতিদিন এই বাজারে লিচু আসে বলে জানালেন বসুন্দিয়া বাজারের আড়তদার বসুন্দিয়া ট্রেডার্সের মালিক মো. নবিনুর খান। তিনি বলেন, ‘এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে লিচু আসছে। এগুলো দেশি। সাইজ ছোট-বড় হলেও পরিপক্ব। স্বাদ মিষ্টি ও হালকা টক-মিষ্টি। দাম প্রতিদিন ওঠানামা করে। প্রতি হাজার ১৪০০-২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোটগুলোর দাম কম, বড়গুলোর দাম বেশি।’
বসুন্দিয়া গ্রামের একটি বাগানে চাষিরা গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন, পরে গণনা করে আঁটি বাঁধছেন
আমার আড়তে প্রতিদিন ছয়-সাত লাখ লিচু বিক্রি হয় উল্লেখ করে নবিনুর খান বলেন, ‘প্রতি হাজারে বিক্রেতা ও ক্রেতার কাছ থেকে ৫০ করে ১০০ টাকা নিই।’
এই বাজারে প্রতিদিন ৫০-৬০ লাখ লিচু বেচাকেনা হয় জানিয়ে এই আড়তদার বলেন, ‘এক থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়। সব জেলা থেকে এখানে আসেন বেপারিরা। তবে বেশিরভাগ সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও বরিশালের।’
এ বছর বিভিন্ন স্থানে ফল পাঠাতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে দ্রুত ফল বিভিন্ন স্থানে পাঠানো যাচ্ছে। গত বছরও ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছিল।’
এই বাজারের প্রতি আড়তে কাজ করেন অর্ধশতাধিক কর্মী। প্রতিদিন এই আড়তে ১৪-১৫ লাখ লিচু বেচাকেনা হয়। তিনিও কমিশন এজেন্ট। রেজা মোল্যা জানান, মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে লিচু থাকবে।
স্থানীয় এক বেপারি বলেন, ‘আমি ছয়-সাতটি ট্রিপ (পিকআপ) পাঠিয়েছি বগুড়ায়। প্রতি ট্রিপে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার পিস লিচু পাঠিয়েছি।’
বসুন্দিয়া এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ফল বাজার। লিচু ছাড়াও মৌসুমি ফল কাঁঠাল, আম, জাম, সফেদা ও আতা বিক্রি হয়। ফলের ব্যবসা ঘিরে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাজারে পাঁচটি আড়ত; দুই শতাধিক শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন।
এ ছাড়া ভ্যানচালক, ফলপাড়া শ্রমিক, গন্তব্যে পাঠানোর জন্য মেহগনি পাতা সরবরাহকারী আছেন। ভ্যানে ফল সাজাতে পরিমাণের ওপর নির্ভর করে প্রতি গাড়ি পাতা বিক্রি হয় ৪০০-৮০০ টাকা।