—:একাত্তরের মুক্তচিন্তা:–
“কাঁদো বাঙালীরা কাঁদো”
আজ রক্তাক্ত আগষ্ট এর শুরু, ১৯৭৫ সালে এই মাসেই বাঙালী হারিয়েছিলো তার জাতির জনককে, দুইজন কন্যা হারিয়েছিলো তাদের পিতা, মাতা, ভাই সহ নিকটজনদের । এটি শুধু একটি সাধারণ হত্যাকান্ডই ছিলো না, এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে পালটে ফেলা হয়েছিলো বাঙালী জাতির অস্হিত্ব, আত্ন মর্যাদা বোধ, অহঙ্কার, পরিচয় । ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত অর অসংখ্য মা-বোনের সম্ব্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চার মূল নীতিকে বিসর্জন দিয়ে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুল্যবোধ দুরেঠেলে দেওয়া হয়, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে যে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোষর রাজাকার-আলবদর-আলসামস-দালালদের কাছ থেকে যুদ্ধজয় করে আমরা ছিনিয়ে নিয়েছিলাম তা এক ধাক্কায়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিন্ধুনদের ওপারে । গনতন্ত্রকে হত্যা করা হয় সামরিক ফরমানে, রাজাকারকে বানানো নয় প্রধানমন্ত্রী, অসৎ, ধান্দাবাজ রাজনৈতিকদের নিয়ে দল গঠন করা হয়,বাংলাদেশ বেতার রেডিও পাকিস্তানের আলোকে বাংলাদেশ রেডিও হয়ে যায়, একই অবস্হা হয় টেলিভিশনর, বাঙালী জাতীয়তাবাদ হয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ,,বাঙলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠানো হয় সকল গণমাধ্যম থেকে, যাদের গুলি বোমায় আমাদের রক্ত ঝড়েছিলো তারাই হয়(আমেরিকা,চীন, পাকিস্তান, সৌদিআরব, লিবিয়া) পরমবন্ধু ।
এখন হজ্বের মৌসুম, সারা পৃথিবীর লক্ষ-লক্ষ মুসমান সৌদিআরব যাচ্ছেন তাঁদের পবিত্র হজ্বব্রত পালনের জন্য । মুসলমানদের পবিত্র স্হান মক্কায় যাতে বাঙালী মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় আচার হজ্বব্রত পালন করতে পারেন তার জন্য তৎকালীন স্বৈরশাসক সৌদি বাদশা ফায়সালের সাথে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাদের হিমালয় সম বঙ্গবন্ধুকে তার একটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরে আজকের বঙ্গবন্ধুর উপর নিবেদন শেষ করবো, অথচ এই ঘৃণিত বাদশা ফায়সালের নামে জামাত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এখনও কোটি কোটি প্যাট্রডলার আয় করছে ।
তথ্যসূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল, এম আর আক্তার মুকুল
সৌদি আরব যেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেদিন বঙ্গবন্ধুর জানাযা পড়া হচ্ছে এদেশে। ১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫।।
৭১ এ আমরা স্বাধীন হলেও ওদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত।।
থাক সেসব কথা। যেটা বলতে চাচ্ছিলাম তা হলো, ৭১-৭৫ এই দীর্ঘ সময়টুকু সৌদির জন্য বাংলাদেশ নামক কোনো দেশের অস্তিত্ব না থাকায় বাংলাদেশীরা হজ্ব করতে যেতে পারছিলেন না।।
বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ৭৩ এর দিকে ইন্দিরা গান্ধি একটি অর্ডিনেন্স পাশ করেন, যেখানে বলা হয় বাংলাদেশীরা ভারত থেকে হজ্ব যাত্রা করতে পারবে।।
কিছু মানুষ এভাবে হজ্ব পালন করেছেন বলে জানা যায়। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকতা প্রদর্শন ছাড়াও অন্যান্য জটিলতায় এই ব্যাবস্থা বেশ টেকসহ হয়ে ওঠেনি।।
বঙ্গবন্ধু সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পরেন। অনেক কুটনৈতিক আলোচনা করেও সৌদি সরকারের নাগাল পাওয়া যাচ্ছিলো না।।
এমতাবস্থায় ৭৩ এর ৫ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে চতুর্থ ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। বৈঠক চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৌদির বাদশাহ ফয়সালের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।।
বাদশা ফয়সাল এলেন। দুই নেতা পাশাপাশি সোফায় বসলেন। বাদশা ফয়সালের দোভাষী বসলেন মাঝখানে। পারস্পরিক স্বাস্থ্য ও কুশল বিনিময়ের পর কথপোকথন শুরু হলো।
কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরলাম,
বাদশা ফয়সালঃ আমি শুনেছি যে, বাংলাদেশে আমাদের কাছে কিছু সাহায্য আশা করছে। আপনি আসলে কি ধরনের সাহায্য চাচ্ছেন। আর হ্যাঁ, যে কোন ধরনের সাহায্য দেওয়ার আগে আমাদের কিছু পূর্বশর্ত আছে।
মুজিবঃ ইউর এক্সেলেন্সী। আশা করি আমার দুর্বিনীত ব্যবহার ক্ষমা করবেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমার মনে হয় না বাংলাদেশ ভিক্ষার জন্য আপনার কাছে হাত বাড়িয়েছে।
ফয়সালঃ তাহলে আপনি সৌদি আরবের কাছে কি আশা করছেন?
মুজিবঃ বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবায় গিয়ে ইবাদত পালনের অধিকার দাবী করছে। যদি ইবাদত পালনের জন্য আপনার কোন পূর্বশর্ত থেকে থাকে তাহলে আপনি তা বলতে পারেন। আপনি পবিত্র কাবা শরীফের তত্ববধায়ক। বাঙালী মুসলমানদের কাছে আপনার স্থান অনেক উচুতে। একথা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদেরই সেখানে ইবাদত করার অধিকার রয়েছে। সেখানে ইবাদত পালন করার কোন প্রকার শর্ত আরোপ করা কি ন্যায়সঙ্গত? আমরা সমঅধিকারের ভিত্তিতে আপনার সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ন সম্পর্ক চাই।
ফয়সালঃ কিন্তু এটা তো কোন রাজনৈতিক আলোচনা হলো না। দয়া করে আমাকে বলুন আপনি সৌদি আরবের কাছে আসলেই কি আশা করছেন?
মুজিবঃ ইউর এক্সেলেন্সী। আপনি জানেন যে, ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আমি জানতে চাই, কেন সৌদী আরব স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়নি?
ফয়সালঃ আমি অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে জবাবদিহিতা করি না। তবু আপনাকে বলছি, সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে “Islamic Republic of Bangladesh” করতে হবে।
মুজিবঃ এই শর্ত বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের জনগনের অধিকাংশ মুসলিম হলেও, আমার প্রায় এক কোটি অমুসলিমও রয়েছে। সবাই একসাথে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, ভোগান্তিতে পড়েছে।
আর সর্বশক্তিমান আল্লাহ শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই নন। তিনি বিশ্বভ্রমান্ডের স্রষ্টা।
ইউর এক্সেলেন্সী, ক্ষমা করবেন, তাছাড়া আপনার দেশের নামও তো “Islamic Republic of Saudi Arabia” নয়। বাদশা ইবনে সৌদের নামে নাম রাখা হয়েছে “Kingdom of Saudi Arabia”। আমরা কেউই এই নামে আপত্তি করিনি।
এ সময় অনাকাঙ্খিতভাবে শেষ হয় আলোচনা। উঠে পড়েন বাদশা ফয়সাল। দু নেতা বেরিয়ে যেতে থাকেন।
যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন সেই আয়াত, “লা-কুম দ্বীন-কুম ওয়াল-ইয়া দ্বীন”।।
সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরা হিমালয় কে চিনে নিও প্রজন্ম। তোমাকে লীগ করতে হবে না, দল করতে হবেনা, তোমাকে ৭১ করতে হবে।
তোমাকে মুজিবে এসে থামতে হবে।
বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।
ডি এম শাহিদুজ্জামান
০১/০৮/২০১৯