অরূপ তালুকদার :
বছর দুই আগে মিয়ানমার থেকে জীবনভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফিরে যাবার বিষয়টি যেন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, আসলে কবে নাগাদ এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবে বা আদৌ তারা যাবে কি না! তবে তাদের পুনরায় ফিরে না যাওয়ার চিন্তাটা আমরা কোনোভাবেই এখনও ভাবতে চাচ্ছি না।রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও জটিল বলে মনে হচ্ছে ২২ আগস্ট তাদের ফিরে যাবার উদ্যোগটি আবারও ব্যর্থ হবার পরে। এ ব্যর্থতার দায়ভার কে বা কারা নেবে জানি না, তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আয়োজনের কোনো ত্রæটি ছিল না। বরং বলা যায়, নির্ধারিত ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গা যাদের ওই দিন ফিরে যাবার কথা ছিল তাদের একজনও ফিরে যেতে চায়নি নানা অজুহাতে। সে দিনের সব আয়োজনই ব্যর্থ হয়ে গেছে। তারা প্রথমত শর্ত জুড়ে দিয়েছিল পাঁচটি। যার মধ্যে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়াসহ নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল প্রধান। কিন্তু তাদের এই চাওয়ার ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসে, তারা তাদের নাগরিকত্ব চাইছে কি এখানে বসেই? মিয়ানমারে ফিরে না গেলে তারা তাদের নাগরিকত্ব পাবে কী করে? কে দেবে? প্রসঙ্গত, একটু পেছনে ফেরা যাক, বিগত ১৯৭৮ সালেও তাদের নাগরিকত্ব ছিল বলে জানা যায়। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার আইন করে তাদের সেই নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। তখন তারা তাদের নাগরিকত্ব হরণের বিরুদ্ধে কতটা কী করেছিল, সে সম্পর্কে নানারকম কথা আছে। তবে পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব শুরু হবার পরে তাদের নৃতাত্বিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার পরিপ্রেক্ষিতে কফি আনান কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছিল শেষাবধি তাও কাগজে কলমেই থেকে গেছে নানা অজুহাতে। আলোর মুখ দেখেনি।
স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে যেসব রোহিঙ্গা অপেক্ষাকৃত কম অত্যাচারিত হয়ে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিল তাদের বেশিরভাগের প্রত্যাবাসনই হয়েছিল তখন তাদের কাছে থাকা আগের সেই নাগরিকত্বের কাগজপত্র অনুসারেই। এবারে কিন্তু তা হচ্ছে না। এখন তাদের হাতে বলা যায়, তেমন কিছুই নেই।
ধারণা করা যায়, তাদের এবারের প্রত্যাবসনের ক্ষেত্রে এটা একটা মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করেছে। আর এ সুযোগ নিয়েই মিয়ানমার একসময় বলেই ফেলেছে যে, এসব রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিকই নয়। এ ধরনের সমস্যা মিটিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কখন কীভাবে হয়, সেটা একটা কঠিন প্রশ্ন বটে।
আগের দুবারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়া ও তাদের ফিরে যাবার বিষয়টা তেমন কঠিন ছিল না। তার সবচাইতে বড় কারণ ছিল তখন তারা সংখ্যায় ছিল অনেক কম এবং হাতে কিছু না কিছু কাগজপত্র ছিল। কিন্তু এবারে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। অনেকটা জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়ায় নারকীয় অত্যাচারের মাধ্যমে এবারে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে একেবারে দেশছাড়া করা হয়েছে।
বিদেশি সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তারা দেশ ছেড়ে পালাবার পরে তাদের পরিত্যক্ত ভ‚মিতে যা কিছু ছিল সব ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করে বুলডোজার চালিয়ে একেবারে সমতল ভ‚মিতে পরিণত করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। ফলে এখন এসব শরণার্থীদের কেউ গিয়ে হয়তো নিজের আবাসস্থলই আর খুঁজে পাবে না। এসব ঘটনা এতদিনে সবাই যেমন জেনে গেছে, রোহিঙ্গারাও জেনেছে। আর হয়তো তাই তাদের এই প্রত্যাবাসনের অনিশ্চিত যাত্রায় কেউ শামিল হতে চাইছে না। এটাই বাস্তব সত্য।
সাংবাদিকদের কাছে এদের কেউ কেউ তাদের ভবিষ্যতের আশঙ্কার কথা এভাবে বলেছে, তারা ওখানে আবারও ফিরে যাবার পরে যদি আবার তারা এমনি ধরনের অত্যাচারের মুখে পড়ে তখন তো তাদের আর কোথাও যাবার জায়গাও থাকবে না। তখন তাদের স্থান হবে নিশ্চিতভাবে গণকবরে। অবস্থাদৃষ্টে তাদের এসব আশঙ্কার কথা যে একেবারেই যুক্তিহীন, সেটা হয়তো বলা যাবে না।
কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশ সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে যে মহানুভবতা ও মানবতার খাতিরে তাদের যেভাবে আশ্রয় দিয়েছেন, বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছেন দীর্ঘ দুই বছর ধরে তার কি কোনো তুলনা হয়?
সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার তো মোটামুটি একটা হিসাব আছে, দুই বছরে তা বেড়ে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও লক্ষাধিক মানুষ। এর বাইরে আগের আছে প্রায় লাখ দুয়েক। এসব হিসেবে করতে গেলে তো রীতিমতো হতবাক হয়ে যেতে হয়। যেসব স্থানে এদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেসব স্থানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এখন দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে সেসব জায়গার রাস্তাঘাট, দোকানপাট, স্থানীয় অবকাঠামো এবং পরিবেশের ওপর যে চাপ পড়েছে, তা স্থানীয় অধিবাসীরা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছেন। তবু সব যেন তারা অবলীলায় সয়ে যাচ্ছেন। এরপরেও যদি আগামী আরও ২-৫ বছর এভাবে রোহিঙ্গাদের এখানে থেকে যেতে হয় তাহলে ভবিষ্যতে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, সেটা ভাবতে গিয়ে স্থানীয় জনগণ রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। কিন্তু এতসবের পরেও কথা সেই একটাই তাদের কি জোর করে সেই বধ্যভ‚মিতে ফেরত পাঠানো যায়? প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো বলেছেন, ওদের আমরা জোর করে ফেরত পাঠাতে পারি না।
তাহলে কী হবে এখন? দেখা যাচ্ছে, নানারকম কথা বলে, ফন্দিফিকিরের ক‚টচাল রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত করে তুলেছে মিয়ানমার। তারা ভেতরে ভেতরে কাদের বলে এত বলীয়ান হয়ে উঠেছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, তারা নানা কৌশলে কালক্ষেপণ করছে। সময় নষ্ট করছে। তাই সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ঢাকাস্থ ক‚টনীতিকদের এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের আস্থাহীনতা দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে মিয়ানমারকেই। ওদিকে চীন এবং ভারত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু আবাসনের ব্যবস্থা করেছিল, তাদের সে উদ্যোগওতো এবারে কাজে লাগল না। এখানে আরেকটা প্রশ্ন আছে, এ রকম সামান্য সংখ্যায় যদি ফেরত যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরুও হয়, তাহলে কত বছর লাগবে সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত যেতে? তবে এসব এখনও প্রশ্নের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে, শুরু হয়নি কিছুই।
এদিকে ২২ আগস্টের পর ২৫ আগস্ট তাদের বাংলাদেশে আসার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে লাখ লাখ রোহিঙ্গা একটা বিশাল সমাবেশ করেছে। মাত্র দুদিনের মধ্যে তারা এমন একটি সমাবেশের আয়োজন করল কীভাবে? কারা তাদের সহায়তা দিল নানারকম উপকরণ দিয়ে? তাদের হাতে হাতে এত মোবাইল ফোনই বা এল কীভাবে? কীভাবে পেল তারা এত সিমকার্ড? হাজার হাজার রোহিঙ্গার হাতে এত অর্থই বা এল কোথা থেকে? এসব ছাড়াও হাজার হাজার রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেল কেমন করে? এসব প্রশ্ন নিয়ে স্থানীয়রা যেমন তেমনি দেশের সাধারণ মানুষরাও নানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে আলোচনা সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে।
অন্য দিকে, রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে শত শত জানা অজানা এনজিও কী কাজে ব্যস্ত রয়েছে, তাদের সার্বিক ভ‚মিকাই বা কী এসবও সবার কাছে এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, দিচ্ছে।
তবে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, বিভিন্ন দেশের এত চাপ এবং বাংলাদেশের এত উদ্যোগ আয়োজন আর আন্তরিকতা থাকার পরেও আবার কবে থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সেটাই শুধু দেখার বিষয়। তবে কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না মিয়ানমার।
শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, লেখক
salo